বেহেশতী আলোয় আলোকিত মন্দ মানুষ
ফয়জুল্লাহ শিবলী
(আজকের গল্পটি কোন কাল্পনিক গল্প নয় ইতিহাসের গল্প)
কুফার মন্দ লোকটি মারা গেছে। জারাদ যার নাম।
মন্দ লোক বলতে যা বুঝায় জারাদ ছিল ঠিক তাই। চুরি-ডাকাতি, মদ- নারী, তাস-জুয়া কোন কাজে সে হাত পাকাইনি?
সব মন্দ কাজের অন্য নাম ছিল কুফার এই জারাদ। এলাকার মানুষ ঘৃণা করতো তাকে অনন্যপায় হয়েও কেউ তার কাছে ঘেঁষতে না।
সেই জারাদ আজ মারা গেছে এলাকার লোকদের জন্য স্বস্তি।
খেলাফতের কি একটা জরুরী কাজে খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সেদিন কুফায় ছিলেন।
তিনি খলিফা আমিরুল মোমেনীন সমস্ত মুসলমানের নেতা তিনি। তার কাছে পাপীতাপী সবাই সমান সবাই প্রজা তাই যখন তিনি একজন কুফাবাসীর মরার খবর শুনলেন হাজির হলেন তার জানাযায়।
জানাযার পর খলিফা শরিক হয়েছেন জারাদের দাফনেও। ধরে নামানো হচ্ছে জারাদকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে তার মৃতদেহ।
এমন সময় কাঁদতে কাঁদতে গোরস্থানে এলেন জারাদের মা ।শহরে ছিলেন না তিনি। ছেলের মরার খবর পাননি আগে। যখন পেলেন ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে কবরে শুইয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে জারাদের প্রাণহীন দেহ।
কিন্তু জারাদের মাকে কে মানাবে?
ছেলে মন্দ হতে পারে দুশ্চরিত্র হতে পারে শহরের সব লোক ঘৃণায় রি রি করতে পারে কিন্তু তিনি তো মা । মায়ের কাছে জারাদ তার নারীছেড়া ধন। সেই মা ছেলের মুখটি শেষবারের মতো দেখতে পারবেন না? তা কি হয়!
ছেলেকে কবরে শুয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে শবযাত্রীরা। তাই বলে মায়ের কলিজা ছেড়া সন্তানের প্রিয় মুখটি কি একবার দেখবেন না মা?
তিনি যে গর্ভধারিনী! ছেলের মুখটি শেষবারের মতো একটিবার দেখতে চান তিনি।
মা কাঁদতে কাঁদতে একে ধরছেন,ওকে ধরছেন, কারো হাত ধরেছেন,কারো পায়ে পড়ছেন।
অনুনয় করে বলছেন কবরের মাটি সরিয়ে তার সন্তানকে একবার দেখাতে। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না মাটিতে ঢেকে দেওয়া জারাদকে দেখাতে। মাঝে একবার দেখবেনই প্রিয় সন্তানকে!
অবশেষে মা আঁকড়ে ধরলেন খলিফা হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর আস্তিন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নবীর মমতার পরশে ধন্য যিনি-বুড়ির আকুল অনুনয় উথলে উঠলো তার মন।
খলিফা শবযাত্রীদের অনুরোধ করলেন কবরের মাটি সরিয়ে জারাদের মুখটি একবার তার মাকে দেখাতে।
ফের খোঁড়া হল মাটি। ধীরে ,আস্তে। আলতো হাতে শবযাত্রীরা কবরের মাটি সরিয়ে রাখছে একপাশে।
একসময় দেখা গেল কাফনের সাদা কাপড়।
এগিয়ে এলেন খলিফা, এগিয়ে এলেন মা। সাবধানে কেউ একজন খুললেন কাফনের সাদা কাপড়। ওকি!
এত আলো এলো কোথা থেকে? আলোয় আলোয় ঝলমল সারাকবর। মৃত জারাদের মুখ থেকে কি এক ঐশি বিভা যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে।
সে বিভায় আলোকিত হয়ে উঠেছে তার কবর এবং আশেপাশের সব কিছু এই যে অপার্থিব আলোকআভা! এই যে বেহেশতীজ্যোতি!
কবরের এদৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলেন খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। ভীষণ অবাক হলেন জারাদের মা আর সবাই।
এও কি সম্ভব???
খলিফা জারাদের পরিচিতদের কাছে জানতে চাইলেন তার দ্বীনদারী আর চারিত্রিক গুণাবলীর কথা।
সবাই এক বাক্যে নাখোশ।না জারাদের এমন কোন দ্বীনদারী ভালো কাজের কথা তাদের মনে আসছে না।
বারবার মনে পড়ছে জীবনভর তার করা অপরাধ গুলো। এমন কোন মন্দ কাজ নেই যা সে করে নি।একজন নিপাট দুশ্চরিত্র ছিল সে ।
অমন আলোকময় বেহেশতী বিভায় স্নাত হওয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানা নেই কারো।
তার মাকে জিজ্ঞেস করা হলো।না, বিনয় ভঙ্গিতে তিনিও জানালেন।ছেলের নেক কোন কাজের হদিস তার জানা নেই।
মায়ের দেখা শেষ। ফের মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল জারাদের শবদেহ।কিন্তু খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর মনে উথিত প্রশ্ন ঢাকা পড়লো নানা কিছুতেই।
এমন এক বাপের চেহারা এমন স্বর্গ জ্যোতি? কিছুতেই মিলাতে পারছেন না তিনি।।
সারা দিন গিয়ে রাত নেমে এলো কুফায়।
খলিফা খেলাফতের দাপ্তরিক কাজ শেষ করে রাতে ঘুমাতে গেলেন।তার মনে তখনো ভেসে উঠছিল জারাদের আলোকিত মুখখানি। কি অপার্থীব অপরূপই না লাগছিল তাকে!
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। স্বপ্ন দেখলেন অনন্ত মুর্শিদ তার জীবনের সঙ্গী প্রিয়তম বন্ধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। আর কি অবাক ব্যাপার!
রাসুলের পাশেই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা বসে আছে কুফার মন্দ মানুষ জারাদ।অবাক হলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ভীষণ অবাক হলেন জারাদের মত একজন সর্ব দোষে দূষিতলোক কিভাবে এমন মর্যাদা পেতে পারে ?কোন কারণে?
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন,
এই মন্দ লোকটিকে কবর দেয়ার সময় তার নুর আলোকিত চেহারা দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন আবুবকর এই লোকটি সত্যিকার অর্থেই বড় গুনাগার পাপী ছিল।
কিন্তু পাপ করার পর সে একা কি গভীর রাতে নিজের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে রোনাজারি করত।
দুচোখের পানিতে অনুশোচনা করতো আবার পাপ করত আবার নিজ ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে একা একা কাঁদতো।
কেউ জানত না কেউ বুঝতো না শুধু আল্লাহ জানতেন আল্লাহ বুঝতেন তার মনের অনুশোচনা। তার কাছে বড় প্রিয় ছিল এই মন্দ লোক জারাদের চোখের পানি।
এই কারণেই তিনি তার মরার পর তার সব পাপ মোচন মুছে দিয়ে বিভূষিত করেছেন।।
ঘুম থেকে জেগে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আল্লাহর শোকর আদায় করলেন ।
💕💕💕💕 সমাপ্ত 💕💕💕💕