মায়াবতী
তাহমী চৌধুরী
মায়া এই দিকে আয় তো মা!
তরকারীটা কেটে দিয়ে যাবি___
মায়া মেয়েটা মাত্র ক্লাস ফোর এ পড়ছে,,,এখন যে সময়টা যাচ্ছে ওর হেসেখেলার সময়।
কিন্তু মায়ার ভাগ্যে যে সময়টা উপভোগ করার কোন সুযোগ হয়ে উঠে নি।
সেই ছোট্ট কালেই মা মারা গিয়েছে! মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবার বিয়ে করেছে,,,বাবার স্ত্রী হয়ে মহিলাটি এলো কিন্তু মায়ার মা হতে পারলো না।
চুন থেকে পান কষলেই ছোট্ট মায়ার উপর চলে অমানবিক নির্যাতন!
ছোট্ট মায়াটি কখনো এইভাবে মার খায় নি! অনেক আদর সে পেয়েছে ছোট্ট কালে,,কিন্তু যখন মায়া নিজে হাটতে শিখেছে তখন থেকেই সবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েই যাচ্ছে।
যখন মায়া হাটতে শিখলো এক পা দু পা করে তখনই চলে গেলেন মায়ার মমতাময়ী মা!
মায়ার মা চলে যেতেই বাবা ও যেন হয়ে গেলেন অন্যরকম! নিজের অবুঝ শিশুটি খেয়েছে কি না ভালো আছে কি না সেই খোঁজ খবর ও রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না তিনি!
ছোট্ট মায়া মা চলে যাওয়ার পর থেকেই হয়ে যায় শান্ত!
কিন্তু মায়ের উপস্থিতিতে ছিলো সে ভীষণ চঞ্চল……
মায়ার চঞ্চলতা যেন দিন দিন আধারে হারিয়ে যায়!
মাঝে মাঝে একলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে মায়া!
সেদিন বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করায়,,বাবা বিরক্ত হয়েই বলেছিলো,,
তোর মা আকাশের তারা হয়ে গেছে! সেই থেকেই বাবার কথাটি বিশ্বাস করে নেয় ছোট্ট মায়া।
তাই তো রাত হলেই ছুটে আসে আকাশ দেখতে!
আকাশে যখন মেঘের আনাগোনা দেখা যায়, ছোট্ট মায়ার মুখটা ভারী হয়ে উঠে যে আজ সে তার তারা মাকে দেখা হবে না।
-বাবার স্ত্রীটা আমাকে ভীষণ বকাঝকা করে!
দেখো মা,,এক কালচিটে দাগ দেখতে পারছো হাতে,,
বাবার স্ত্রী আমাকে মেরে এইভাবে করেছে!
মা তুমি তো কখনো এইভাবে আমায় মারো নি,,,
ও মা! আমায় তোমার সাথে নিয়ে যেতা! প্রতিদিন এইভাবে মার খেতে ভালো লাগে না মা! কষ্ট হয় তো আমার।
ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ছোট্ট মায়া!
একদিন হঠাৎ মায়ার বাবা ঘরে এসে দেখে তার স্ত্রী মায়াকে চুল ধরে মারছে,,মায়া বারবার চিৎকার করে উঠছে ব্যথায় কিন্তু তারপর ও মন গলে নি মহিলাটির।
সেদিন মায়ার জন্য বাবার মন গলে উঠে!
তাই তো পরের দিনই মায়াকে দিন যান তার নানুবাড়ি মামীর কাছে মামীর সংসারে!
সেখানে না কি সে ভালো থাকবে এই আশায়।
প্রথম কয়দিন মায়া ছিলো অনেক ভালো! তার চাঞ্চল্য ভাবটা যেন ফিরে আসছিলো আস্তে আস্তে……
অনেক আগের কথা,,
সেদিন মায়া গিয়েছিলো স্কুলে মামাই ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো ক্লাস ওয়ানে।
স্কুল থেকে ফিরার পথে মায়া বারবার বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো কৌতুহলে বারবার বইগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলো,,,
স্কুল থেকে ফেরার পর মায়ার উপর মামী আর্জি করে উঠেন মায়া যেন এখন থেকে রান্নার কাজে উনাকে সাহায্য করে!
ছোট্ট মায়া রান্নার কাজ কি করে করবে,,ওর তো এখন রান্নাবান্না করার সময় নয়,,,কথাটি বলেছিলো মায়ার মামা!
কিন্তু মামী ছিলেন ভীষণ রাগী! আর মামা ছিলেন মামীর বাধ্য!
মামী মামার কথার উত্তরে চোখ গরম করে তাকাতেই মামা সেখান থেকে নিরবে সরে যান………
ছোট্ট মায়া আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মামীর আঁচল ধরে বললো,,,
-চলো মামী আমি রান্না করবো!
ছোট্ট মায়া পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মামীর আঁচল টেনে বলে,,,
-মামী চলো আমি রান্না করবো।
.
সেইদিন থেকে আজ ৪ টি বছর মামীর সংসারে কাজের মেয়ের মতো খেটে যাচ্ছে মায়া! মাত্রই তো ক্লাস ফোরে পড়ছে,,এই বয়সের মেয়েরা থাকে চঞ্চলা ও প্রাণবন্ত!
কিন্তু মায়ার মাঝে তার একটিও গুণ নেই,,,মায়া মেয়েটি যেন দুনিয়ার সব হাবভাব বুঝে গেছে,,তার মাঝে নেই কোন চঞ্চলতা,,আছে শুধু গম্ভীর গম্ভীর ভাব!
রাত্রী ১০.০০ টা মায়া ছোট ছোট পা নিয়ে তরকারির বাটিগুলা টেবিলে রাখছে!
মামীর বাবার বাড়ি থেকে মামীর ভাই ও মা-বাবা এসেছেন!
ছোট্ট মায়াকে দেখে মামীর ভাইটা কাছে টেনে নিয়ে বললো,,
-আপা মেয়েটা তো ভারী মিষ্টি……
এই বলে লোকটা মায়ার পিটে হাত বুলাতে লাগলো!
মায়া সরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো,,কারণ লোকটার পিটে হাত বুলানো মায়ার খারাপ লাগছিলো ভীষণ।,
লোকটা পিটে হাত বুলানোটা কোন মমতার মনে হয় নি মায়ার,,,
-আচ্ছা লোকটা মামীর ভাই হলে আমার তো মামা হবে!
নিজে নিজেই কথাগুলা ভাবছিলো মায়া,,,
কথা বলতে বলতে লোকটা মায়ার গালে চুমো দিয়ে দিলো,,,মামী তা দেখে মিষ্টি হাসলেন,,উনার কাছে এটা স্বাভাবিকই মনে হয়েছে!
মায়া লোকটার থেকে এক ঝটকায় ছুটে এসে বলল,,
-মামা মামা! আপনি খুব পচা খুব পচা……
ছোট্ট মায়া চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে সে স্থান ত্যাগ করলো,,,
মায়ার যাওয়ার পানে মামী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন…
মায়া স্কুলে যাওয়ার সময় মামা মাঝে মাঝে ১০ -২০ টাকা দিতেন,,সেই টাকা মায়া জমিয়ে রেখে দিতো,,
আজ সেই জমানো টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা ডায়রি কিনলো মায়া……
সেই ডায়রিতে আধো আধো অক্ষরে কি যেন লিখে রাখে সে,,মায়া ছাড়া সেই কথাগুলা কেউই জানে না!
আজ মামীর ভাই আবার এসেছেন!
লোকটাকে দেখার পর থেকেই মায়া দূরে দূরে থাকছে! লোকটাকে মায়ার একদম ভাল্লাগেনা।
লোকটার তাকানো মায়ার কাছে ভয়ংকর লাগে!
সেদিন লোকটা মায়াকে একা পেয়ে কি শক্ত করেই না জড়িয়ে ধরেছিলো,,যদি মায়া হাতে কামড় দিয়ে পালিয়ে না যেত তাহলে কি হতো,,ছোট্ট মায়া এতোসব আন্দাজ ও করতে পারে না!
খারাপ লাগে লোকটাকে মায়ার,,খারাপ লাগে লোকটার স্পর্শ কিন্তু কথাগুলা কাউকে বলতে পারে না মায়া!
তার কথা শুনার মতো যে কেউই নেই!
আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলছে,,,আজ মায়ার ১২ তম জন্মবার্ষিকী!
আকাশের দিকে তাকিয়ে টিপটিপ করে চোখের জল ফেলছে সে!
আজ মামী বিনা দোষে আবার মারলো……!
মামীর ভাইটা আমাকে খারাপ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করে সেটা আজ বুঝতে পারছে মায়া! খুব ভালো করেই অনুধাবন করতে পারছে সে! ঘৃণা হচ্ছে মায়ার,,মানুষ এতোটা নিচ হতে পারে কি করে!
মায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলে,,,
-ও আল্লাহ! আল্লাহ গো,,লোকটা তো আমার বাবার সমান,,তাহলে এইভাবে খারাপ ব্যবহার করলো কেন আমার সাথে! আজ মামীকে এই কথা বলায় মামী আজ খুব করে মারলো! আল্লাহ আমি দোষটা কি করেছি,,আমাকে কেন মার খেতে হলো।।
আল্লাহ আমায় তুমি রক্ষা করো আল্লাহ! আমার আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না!
ওরা খুব খারাপ খুব!
হাতের উল্টো পিট দিয়ে দু চোখ মুছে ঘরের দিকে পা বাড়ালো মায়া।
মামা মাত্রই বাজার থেকে বাড়ি ফিরলেন,,,মায়া মামার হাত থেকে বাজারের ব্যগটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।
মায়া চলে যেতেইই মামী হতভম্ব হয়ে মামার কাছে ছুটে এলেন,,,
-কি হলো এইভাবে ছটফট করছ কেন?
মামীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মামা……
উৎকন্ঠা হয়ে মামী বললেন,,,
-শুনছো! চেয়ারম্যান মায়াকে না কি পছন্দ করে,,স্কুলে যাওয়ার পথে ওকে দেখছে!
তাই ও না কি মায়াকে বিয়া করতে চায়!
মামা রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলেন,,
-পাগল হলে হ্যাঁ! মায়ার বয়স কতো আর চেয়ারম্যান এর বয়স কতো,,,লোকটা মায়ার বাবার বয়সী হবে!
তোমার কি বিবেক জ্ঞান সব শেষ হয়ে গেছে!
-দেখো আমার এতো বিবেক জ্ঞান এর দরকার নাই।
কতোদিন মেয়েটাকে ঘারে বসিয়ে খাওয়াবো,,,বাবার বয়সী হলে হোক তাতে তোমার কি,,তাড়াতাড়ি ও আমার ঘর থেকে বিদায় হোক!
উৎকন্ঠা হয়ে মামীর প্রশ্নের জবাবে মামা বললেনন,,
-খবরদার আর একটা কথা বলবা তো!
আমার বোনের মেয়েকে আমি ঘারে বসিয়ে খাওয়াবো নয়তো কুলে বসিয়ে খাওয়াবো তাতে তোমার কি?হ্যাঁ
কথা বলতে বলতে অনেক বলে ফেলেছো! মায়া আমার মেয়ের মতো,,আর ও ঘারে বসে খাচ্ছে তাই না!
তাহলে প্রতিদিন যে বসে বসে খাও এই খাবারগুলা কে তৈরি করে দেয়!
ঘরের এতোটা সদস্যদের সব কাজ করে দেয়,,এসব কি! এতোদিন কিচ্ছু বলিনি!
আজ বলছি কারণ তুমি বিবেক শূণ্য হয়ে গেছ,,,
ফুলের পাপড়ি পড়ে নি আর মেয়েটাকে তুমি বাবার বয়সী লোকটার সাথে বিয়ে দিতে চাইছো।
আজকের পর থেকে তোমার মুখ থেকে এসব শুনেছি তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না,,বলে দিলাম।
যাও আমার সামনে থেকে,,,
মামী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরে চলে গেলেন,,,
আড়াল থেকে মায়া মামা মামীর সব কথোপকথন শুনে চোখের জল ফেলছিলো,,
মায়ার এই কষ্ট কেউ দেখছে না,,,নিরব কান্না মায়ার সঙ্গী হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মা বেঁচে থাকলে হয়তো মায়াকে কোন কষ্ট পেতেই হতো না……
মামা আওয়াজ দিলেন,,
-মায়া মা! আমাকে এক কাপ চা দে তো!
কাপাকাপা কন্ঠে মায়া বলে উঠলো,,
-আনছি মামা………
মামা(ফজায়েল কারীমকে)
চা এগিয়ে দিয়ে মায়া তার পাশে বসলো,,,
ফজায়েল কারীম মায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
-কিছু বলবি মা?
মায়া ইতস্তত করে বললো,,
-মামা আমাকে একটা বোরকা কিনে দিতে পারবা……?
ফজায়েল কারীম মায়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন,,
-বোরকা দিয়ে তুই কি করবি মা? তুই তো এখনো ছোট্ট আরো বড় হো,,তারপর না হয় বোরকা পড়বি……।
বিনয়ী স্বরে মামার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো মায়া,,
-মামা আমি আর কিচ্ছু তোমার কাছে কখনো চাইবো না,,আমায় বোরকা কিনে দাও মামা……।
-আরে আরে পাগলী মেয়ে কাঁদছিস কেন? আচ্ছা আচ্ছা কালই বোরকা পেয়ে যাবি,,এখন টেবিলে খাবার লাগা!
হাতের উল্টো পিটে চোখ মুছে হেসে উঠলো মায়া……
আজ মামা আমায় বোরকা এনে দিয়েছেন! অনেক খুশি লাগছে আমার!
মা তোমাকে যখন দেখতাম তুমি বোরকা পড়ছ তখন তোমাকে অনেক ভালো লাগতো আমার,,
কিন্তু আমি তখন বুঝতাম না তুমি বোরকা কেন পড়ো……কিন্তু আজ বুঝতে পারছি মা তুমি কেন বোরকা পড়তে!
তুমি মামীর ভাইয়ের মতো খারাপ লোকদের থেকেই বাঁচতে বোরকা পড়তে তাই না মা?
আমিও পড়বো এখন থেকে!
মায়া জানেনা বোরকার গুরুত্ব কি? সে তো পর্দা কি জিনিস জানেই না,,তারপর ও মায়ার কাছে মনে হলো বোরকাই থাকে বাঁচাতে পারবে লোকটার হাত থেকে?
আজ ও মামীর ভাই বাড়িতে এসেছে!
মায়া ঘর থেকে তখন ও বের হচ্ছে না!
মামী কয়েকবার এসে ডেকে গেছেন রান্না করার জন্য!
বোরকাটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো মায়া,,সেই সাথে উড়না দিয়ে মুখে অর্ধেক ও ঢেকে দিলো!
রুম থেকে বের হতেই মায়া লোকটার সামনে পড়লো!
লোকটা মায়াকে দেখে কিছুটা সরে দাঁড়ালো,,
মায়া সালাম দিয়ে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে গেলো!
রান্নাঘরে এসে বিজয়ের হাসি হাসলো মায়া……
আজ লোকটা তাকে ছোঁয় নি,,,অন্যদিন হলে যেখানে পেতো মায়ার শরীর স্পর্শ করতো লোকটা!
কিন্তু আজ……
আজ ৫ বছর পর মামা(ফজায়েল কারীম) ও মামী (জাহানারা বেগম) এর সন্তান মেহরাব সুইডেন থেকে দেশে ফিরছে!
সবাই মেহরাবকে আনতে এয়ারপোর্টে চলে গেছে!
শুধু ঘরে মায়া ই থেকে গেছে!
মামী মায়ার উপর পুরো ঘর পরিষ্কার করার আর্জি দিয়ে গেছেন!
কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে মায়া কাজ করেছে একমনে!
দুধে আলতা মায়ার গড়ন,,চেহারা হয়েছে পুতুলের মতো!
বয়স প্রায় ১৬! ক্লাস ৮ম পর্যন্ত মামার জোরাজোরিতে পড়লেও পরে আর পড়া হয় নি মায়ার!
মামীর সংসারের পুরোপুরি দায়িত্ব নিতে হয়েছে যে তাকে……!
মেহরাবকে সদর দরজায় দেখে মায়া দৌড়ে নিজের রুমে চলে এলো!
মেহরাব মায়াকে এক পলক দেখেই মুচকি হাসলো,,,
মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো সে,,,
-মা পুতুলটা এখনো আমাদের বাড়ি থাকে……
ছেলের মুখে মায়াকে পুতুল ডাক শুনে ভ্রু কুচকে তাকালেন জাহানারা……
পেছন থেকে ফজায়েল কারীম ছেলেকে বলে উঠলেন,,,
-হ্যাঁ বাবা আমাদের পুতুলটা এখনো এইখানে থাকে!
-কত্ত বড় হয়ে গেছে বাবা ও! সেই ১০ বছরের মায়াকে রেখে গিয়েছিলাম!
ফজায়েল কারীম মুচকি হাসলেন……
রাতে মায়া সবার জন্য রান্নার কাজে ব্যস্ত,,ঠিক তখনি রান্নাঘরে মেহরাব ঢুকে!
মেহরাবকে দেখে মায়া ওড়না দিয়ে মুখের উপর ঘুমটা টেনে দেয়!
মেহরাব মায়ার পাশে গিয়ে মুচকি হেসে বলে,,
-কি রে পুচকো! তুই দেখছি লজ্জা পাচ্ছিস!
মায়া জবাব দেয়…
-মেহরাব ভাইয়া! এইভাবে একা গায়রে মাহরামদের সাথে কথা বলা ঠিক না!
আপনি বাইরে যান আমি রান্না করছি!
ভ্রু কুঁচকে মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে মেহরাব……
মায়া বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়,,,উৎকন্ঠার স্বরে মেহরাবকে আবারো বলে মায়া,,
-মেহরাব ভাইয়া……
-হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি বাবা! তুই তো পুরো হুজুর হয়ে গেছিস রে!
মেহরাব যাওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় মায়া!
যেদিন থেকে গায়ে তাকওয়ার পোশাক(বোরকা) জড়িয়েছে মায়া,,,সেদিন থেকে মায়াকে একটূ একটু করে ভাবিয়ে তুলেছিলো!
এই বোরকা পড়ার পর থেকেই সেই খারাপ লোকটার খারাপ চাহনি থেকে বেঁচেছে,,, তারপর যে আরো কতো কঠিন পরিস্থিতি থেকেও উদ্ধার পেয়েছে!
সেদিন মায়া পাশের বাড়ির এক আন্টির কাছে সব বলেছিলো,,,
আন্টিটা ছিলো অত্যন্ত পরহেজগার!
মায়ার সব কথা শুনে উনিই মায়াকে বললেন বোরকা পড়ার গুরুত্ব ও মর্যাদা,, সাথে জানিয়ে দিলেন নামায রোজা পর্দার গুরুত্ব।
মায়া সেদিন থেকে পেয়েছিলো শান্তির জীবন!
মেহরাব মায়ার ছোট্ট কালের ছবি হাতে নিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো!
ছবিতে মায়া মেহরাবের পাশে বসে ছিলো!
দরজায় ঠোকা পড়তেই দ্রুত ছবিটা লুকিয়ে ফেললো মেহরাব!
মায়া চা হাতে নিতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে!
মায়াকে দেখে ভেতরে আসতে বললো মেহরাব!
অনিচ্ছাবশত ভেতরে গিয়ে টেবিলের উপর চা দ্রুত রেখে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মেহরাব সামনে এসে দাঁড়ালো মায়ার!
অনেকটা ভয়ার্ত হয়ে মেহরাবের দিকে তাকালো মায়া……
দু হাত দিয়ে মায়ার মুখের দিকে ইশারা করে বললো মেহরাব,,,
-দেখ মায়া! এসব কি?
এইভাবে মুখ ঢেকে রেখেছিস কেন? আসার পর থেকে তর মুখটাও দেখিনি!
হয়েছে এবার ওড়নাটা সরা তো মুখের উপর থেকে!
মায়া মেহরাবের এমন কথায় দু পা পিছিয়ে গেলো……
কাপাকাপা স্বরে উত্তর দিলো মায়া,,,
-মেহরাব ভাই প্লিজ পথ ছাড়ুন! আমার মুখ দেখা আপনার জন্য জায়েজ নয়!
প্লিজ মেহরাব ভাই……
মেহরাব শান্ত দৃষ্টি নিয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো,,,
মেহরাবের চাহনি দেখে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো মায়া……
মায়ার কথাটি শুনে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো মেহরাব……
ঘরের থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মায়াকে আবার ডাকলো সে…
পেছনে না তাকিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো মায়া,,
অভিমানী কন্ঠে মেহরাব বলল,,,
-চা টাও নিয়ে যা!
মায়া চায়ের কাপের দিকে একবার তাকিয়ে চা না নিয়েই চলে আসতে চাইলে, ধমকে রস্বরে মেহরাব বলে,,,
-কানে যায় নি কি বলেছি আমি……
মায়া ভয় পেয়ে যায় মেহরাবের ধমকে,,তাই তো আস্তে আস্তে টেবিল থেকে কাপ নিয়ে দ্রুত বাইরে চলে আসে……
মায়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে মেহরাব……
-তুই কি আমার অনুভূতিটা বুঝবি না মায়া,,,”মায়াবতী” তোর জন্য যে আমার দেশে আসা……তুই কেন আমার সাথে এমন করছিস!
আমি যে তর এই অবহেলা সহ্য করতে পারি না!
তুই কি কিছু বুঝিস না মায়া,,কিচ্ছুই বুঝিস না……
ঘরের কাজ শেষ করে ফ্যানের নিচে নিজের কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া চুল শুকাতে বসলো মায়া……
মনে মনে মেহরাবের কথা ভেবে বললো মায়া,,
-আমি সব বুঝি মেহরাব ভাই! কারণ আমি যে নারী!
তুমি আমার সামনে প্রকাশ না করলেও আমি বুঝি তুমি যে আমার প্রতি দুর্বল!
কিন্তু আমি আপনার ডাকে যে সাড়া দিতে পারবো না মেহরাব ভাই! আমি যে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছি……
দরজায় আওয়াজ হতেই নিজের ধ্যান সড়িয়ে চুল খোপা করতে করতে দরজা খুলে হা হয়ে যায় মায়া……
মেহরাবের বড় ভাই শিহাব দাঁড়িয়ে আছে,,,,
মায়া তো ভেবেছিলো মামী হবে তাই ওড়নাটাও ভালো মতো মাথায় দেয় নি!
শিহাবকে দেখতেই তড়িঘড়ি করে ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেললো মায়া!
কিন্তু খুব দেড়িতে,, এতোক্ষণে মায়াকে খুব ভালো করেই দেখে ফেলেছে শিহাব!
মায়ার দিকে তাকিয়ে সব দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো শিহাব…
-তোকে তো দেখেই ফেলেছি রে! তা তুই তো খুব সুন্দর হয়ে গেছিস……
শিহাব অন্যরকমভাবে মায়ার দিকে তাকালো!
শিহাবের কথা শুনে মায়ার চোখে জল ছড়িয়ে পড়লো!
সে যে তার সৌন্দর্য প্রকাশ করতে চায় নি!
কিন্তু নিজের ছোট্ট একটা ভুলে যে কতো বড় ক্ষতি হয়ে গেলো,, অনুতপ্ততায় চোখ বেয়ে শ্রাবণ ধারা নেমে আসে মায়ার……
ভাইকে ডাকতে ডাকতে মায়ার ঘরের সামনে এসে থামে মেহরাব!
কিছুটা অবাক হলো সে,, শিহাবকে মায়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে!
কিছুটা এগিয়ে গেলো মেহরাব,,মায়াকে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝে গেলো সব!
তাই তো ভাইকে ডাক দিয়ে সেখান থেকে নিয়ে এসে বললো ,,
-ভাইয়া তকে না বলেছি মায়া আমাদের সাথে পর্দা করে তারপরও ওখানে গেলি কেন?
কথার উত্তরে শিহাব বলে,,
-কি করবো বল! পিচ্চিটাকে দেখতে বেসম্ভব ইচ্ছে হচ্ছিলো,,কতো বছর পর বাড়ি ফিরলাম কিন্তু ওকে দেখতে পারবো না সেটা তো মানা যায় না ভাই,,,তাই তো!
-আচ্ছা বাদ দে! এখন আর দেখার চেষ্টা করিস না!
মুচকি হেসে শিহাব বলে,,
-দেখে তো ওকে আমি ফেলেছিই,,আর দেখবো বিয়ের পর!
ভাইয়ের কথায় মেহরাবের বুকটা ধ্বক করে উঠলো!
কথাটা পরিষ্কার ভাবে শুনার জন্য আবারও প্রশ্ন করলো শিহাবকে,,,শিহাব আবারো সেই উত্তর দিলো!
মেহরাব ভাইয়ের সামনে আর এক মুহূর্ত ও দাঁড়ালো না,,,!
নিজের দুনিয়া উলট পালট হয়ে যাচ্ছিল মেহরাবের,,যেন কলিজা ধরে কেউ টান দিয়েছে!
মেহরাব কিছুতেই ভাইয়ের কথাটি মানতে পারে না!
অজান্তেই চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে মেহরাবের!
বাড়িতে আজ অনেক বড় আয়োজন হচ্ছে!
মায়া এক হাতে কাজ করছে আর মেহমানদের আপ্যায়ন করছে!
চা টা চুলোয় বসাতে বসাতে মায়া হিজাব খুলে নিজের শরীরের ঘাম মুছে আবার মাথায় দিলো।।
মামী এসে তখন মায়াকে বললেন,,,
-যা এখন তুই রেডি হো গিয়ে!
মামীর কথায় মায়ার কষ্ট হয়! কলিজাটা ছিঁড়ে যেতে চায়! মনের এক কোণে মেহরাবের জন্য কিছুটা জায়গা যে তৈরি হয়ে গিয়েছিলো……
কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা ছিলো যে অন্য,,,
মায়া আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে,,আর নিজের মনের কুমন্ত্রণার জন্য ইস্তেগফফার করে!
ঘরে এসে বিছানা থেকে একটা টকটকে লাল শাড়ি হাতে নিলো মায়া!
শাড়িটা হাতে নিতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে!
কেন কাঁদছে মায়া নিজেও জানে না!
এতো কষ্ট কেন হচ্ছে বুঝতে পারে না মায়া!
-এই কি হয়েছে তোর এখানে এখনো বসে আছিস কেন মা!
মামার ডাকে ধ্যান ফিরায় মায়া! শাড়িটা হাতে জড়িয়েই বসে ছিলো সে!
অনুভূতিহীন হয়ে উত্তর দেয় মায়া…
-মামা আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তো!
নিজেকে শান্তনা দিতে পারছি না মামা!
ফয়জাল কারীম মায়ার কথায় কিছু বলেন না,,এগিয়ে গিয়ে পরম আদরে মাথায় হাত বুলান।
কারণ তিনি যে জানেন,,মেয়েটা কেন একথা বললো!
আজ ও সেই অমানুষ বাবাটা আসলো না!
মেয়েটাকে এখানে সেই যে ফেলে গেলো মেয়েটা মরেছে কি না বেচেছে সেই খবরটুকু রাখার প্রয়োজন মনে করলো না!
মায়া কান্না করছে ভীষণ কান্না করছে,,,মায়ার কান্নার সাক্ষী শুধু আল্লাহ!
তার কষ্টের প্রতিটা অশ্রু শুধু আল্লাহই জানেন!
সেজদায় পড়লো মায়া!
“সবরের জন্য সাহায্য চাইলো আল্লাহর কাছে”
পাঁচ মিনিট আগে মায়া কবুল পড়ে অন্যের বউ হয়ে গেলো!
নিকেবের নিচের মায়ার উদাস চেহারাটা কেউ দেখলো না!
কবুল বলার আগেই মুখটাও কেউ দেখলো না মায়ার! তাহলে হয়তো কেউ বুঝতে পারতো মায়া সুখী নয়!
আড়াল থেকে মায়ার কবুল শব্দ শুনে মেহরাব নিজের বুকে শক্ত করে চেপে ধরলো……
মেহরাব এখন বুঝতে পারছে মায়া ইসলামের সব বিষয় আহকাম মানে তাই তো সেদিন মায়া মেহরাবের ডাকে সাড়া দেয় নি! দেয় নি চেহারা দেখতে!
মেহরাব ও মায়াকে দেখে পালটে যায়! আস্তে আস্তে সেও ইসলামের দিকে প্রবেশ করতে থাকে!
তাই তো সেও মায়াকে এড়িয়ে চলতো,,
কিন্তু আজ মেহরাবের বড় ইচ্ছে হচ্ছে মায়াকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলবে,,
-কেন এমন করলে কেন?
তুমি কি বুঝতে না তুমি কি কিছুই বুঝতে না!
মেহরাব চাইলেও পারে না কথাটা বলতে!
ভাবতে ভাবতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো মেহরাবের …
মায়ার বড় ইচ্ছে ছিলো একজন দ্বীনদার কাউকে নিজের জীবনসাথী করতে!
কিন্তু মামা মামীর দিকে তাকিয়ে পারলো না সেই কথাটা বলতে,,,কারণ মামা মামী না থাকলে যে এতোদিন সে বেঁচে থাকতো কি না সন্দেহ ছিলো!
মায়ার ধ্যান ভাঙ্গে শিহাব।
শিহাবকে দেখেই সালাম জানিয়ে খাটের উপর কাচুমুচো হয়ে বসে মায়া……
শিহাব সেদিকে তাকিয়ে এক বিস্ময়কর হাসি হাসে……!
মায়ার মন কু ডাকে কেঁপে উঠে……
শিহাবকে দেখেই সালাম জানিয়ে খাটের উপর কাচুমুচো হয়ে বসে মায়া……
শিহাব সেদিকে তাকিয়ে এক বিস্ময়কর হাসি হাসে……!
মায়ার মন কু ডাকে কেঁপে উঠে……
পরদিন ঠিক ফজরের আজানের ধ্বনিতেই মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়!
ঘুমন্ত শিহাবের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে উঠে মায়া!
এই মানুষটার সাথে কি করে থাকবে? লোকটা যে অত্যন্ত নির্ধয়! কালকের করা শিহাবের ব্যবহারে মায়ার ভেতর ভয় বাড়তে শুরু করে!
পড়নের কাপড় ঠিক করে বিছানা থেকে নামে মায়া!
ওয়ারড্রব থেকে একটা সুতি গাউন নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে!
শরীরটা ক্লান্তিতে ভরে উঠে মায়ার!
শাওয়ায়ের পানি শরীরে লাগতেই ক্লান্তি ভাব দূর হতে থাকে মায়ার!
গোসল সেরে এসে দেখে শিহাব এখনো গভীর ঘুমে!
নামাজের সময় যে অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে,,
শিহাবের পাশে গিয়ে বসে মায়া! ঘুমন্ত শিহাবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকে হালকা ধাক্কা দিতে থাকে শিহাবকে!
ঘুমন্ত শিহাবের চোখে মুখে ফুটে উঠে বিরক্তিভাব!
মায়া তবুও ডাকতে থাকে,,এতো ডাকার পর ও যখন শিহাব উঠলো না তখন হালকা পানি ছিটিয়ে দিলো শিহাবের মুখে মায়া!
হুড়মোড় করে উঠে বসলো শিহাব!
মায়াকে দেখে রাগান্বিত স্বরে বললো,,,
-এসব কি মায়া! পানি ছিটালি কেন?
-কি করবো নামাজের সময় চলে যাচ্ছে আর আপনি এখনো ঘুমে!
-তো কি হয়েছে?
ধমকের স্বরে বললো শিহাব!
শিহাবের ধমকে ভড়কে গেলো মায়া!
আমতাআমতা করে বললো সে,,,
-প্লিজ নামাজটা পড়ে ঘুমান!
বিরক্তি নিয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো শিহাব,,,
-তুই সরবি! আমি ঘুমাবো সর!
মায়াকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে সরিয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে গেলো শিহাব!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়া নামাজে দাঁড়ালো……
নামায শেষে মায়ার চোখ লেগে এসেছিলো!
কিন্তু হঠাৎ করেই কারো চিৎকার চেঁচামেচিতে মায়ার ঘুম উবে গেলো!
দরজা খুলে তড়িঘড়ি করে বাহিরে গিয়ে দেখলো মামী চেঁচামেচি করছেন!
চেঁচামেচির কারণ হলো মায়া!
সে কেন এতোক্ষণ পর্যন্ত শুয়ে আছে? বিয়ে হয়েছে বলে কি আদিখ্যেতা দেখাতে হবে? নাস্তা রেডি হয় নি কেন এতোক্ষণ ধরে?
এসব কথার মাঝখানে মেহরাব এসে ঘরে ঢুকে!
ছেলেকে দেখে প্রচন্ড রেগে গিয়ে জাহানারা বেগম বলেন,,,
-বাহ! সাহেব এসেছেন দেখছি! তা আপনি সারারাত কই ছিলেন বাবাজী?
আপনার কি ঘর দোয়ার ছিলো না,,না বলে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে কোন জবাব না দিয়ে রুমের দিকে হাটা ধরলো মেহরাব!
মায়া রুমে গিয়ে হিজাবটা নিয়ে বেড়িয়ে আসে!
মায়াকে দেখে জাহানারা বেগমের রাগ যেন উপচে পড়ছে!
নীরবে মামীর অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুনে গেলো মায়া!
রান্নাঘরে রুটি ভাজছিলো মায়া!
মেহরাব এসে টেবিলে বসে আওয়াজ লাগালো মাকে!
-মা নাস্তা হয়ে গেলে দাও তো! আমাকে একটু বাইরে বের হতে হবে!
তড়িঘড়ি করে রুটি উল্টেপাল্টে দিচ্ছিলো মায়া!
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হাতের এক কোণে গরম ছ্যাক লেগে গিয়ে ফুচকা ও পড়ে গেছে সে জায়গায়!
এর মধ্যে মামী ও এসে তাড়া দিলেন মায়াকে!
হিজাব দিয়ে মুখ ঢেকে নাস্তা নিয়ে টেবিলে দিলো সে!
মেহরাব মায়াকে দেখেই নিচের দিকে চোখ নামিয়ে ফেললো!
টেবিলে সবার জন্য নাস্তা দিয়ে আবার রান্নাঘরে গেলো মায়া!
চোখের কোণে আসা একটুখানি জল হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিলো মেহরাব!
শিহাব অনেকক্ষণ হলো ঘুম থেকে উঠেছে!
মায়া এসে রুম পরিষ্কার করে শিহাবের জন্য নাস্তা রেডি করলো!
নাস্তা করতে এসে শিহাব একটিবারের জন্যও মায়াকে খেয়েছে কি না জিজ্ঞেস করলো না!
শিহাবের এমন আচরণে মায়াকে ব্যতীত করলো!
খেতে গিয়ে হেচকি উঠে গেলো শিহাবের!
শিহাবের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো মায়া! তড়িঘড়ি করে গ্লাস এগিয়ে দিলো শিহাবের দিকে!
পানি খেয়ে নাস্তার প্লেট ফ্লোরে ছুড়ে মারলো শিহাব!
শিহাবের এমন আচরণে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে!
চিৎকার করে মায়াকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করলো শিহাব!
শিহাবকে বাধা দিয়ে বললো মায়া,,,
-এইভাবে গালি দিবেন না দয়া করে,,মুমিনদের জন্য অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা মানায় না,,,,অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে নীচ লোক!
আর রাগ করবেন না প্লিজ
” রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে”
আপনি শান্ত হোন! পানি খান প্লিজ!
কাপাকাপা হাতে শিহাবের দিকে পানি এগিয়ে দিলে পানির গ্লাস ও ছুড়ে ফেলে দেয় শিহাব!
শিহাবের এমন চেঁচামেচিতে জাহানারা বেগম ও ফজায়েল করীম বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে!
মা-বাবার দিকে একবার তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে টেবিল থেকে উঠে চলে যায় শিহাব!
শিহাবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের জল ছেড়ে দেয় মায়া……।
শিহাব প্রায় ১১টার দিকে বাড়ি ফিরলো,,,টেবিলে খাবার দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো মায়া!
খাবার খাওয়ার সময় একটিবারের জন্যও মায়ার দিকে তাকালো না শিহাব,,তাকালে দেখতে পেতো একজোড়া চোখ তার দিকে অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে!
সারাদিন থেকে একমুঠো ভাত গিলতে পারে নি মায়া! শিহাবের সকালের এমন আচরণ মায়াকে বারবার ভাবাচ্ছিলো!
কেন করছে এমন আচরণ সে? সে তো নিজের ইচ্ছেতেই বিয়েটা করলো!
মামা বা মামী কেউই তো জোর করে নি তাকে!
বরং মামী বাধা দিচ্ছিলেন এতে শিহাব রেগে ও গিয়েছিলো! অত:পর মামী নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েটায় রাজি হোন!
এতোক্ষণে শিহাবের খাওয়া শেষ হয়ে গেলো!
টেবিলের এঁটো বাসনগুলা পরিষ্কার করে রুমে গেলো মায়া!
বুকের ভেতর এক পাহাড় অভিমান এসে জড়ো হয়েছে তার!
বিছানায় উল্টো হয়ে বুকে ভর দিয়ে মোবাইল টিপছিলো শিহাব!
শিহাবকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো মায়া……
-বুকে ভর দিয়ে শুতে হয় না! এইরকম শয়তান শোয়য়।
মায়ার এমন কথায় রেগে গেলো শিহাব!
এক ঝটকায় মায়ার হাত ধরে বিছানায় ফেলে দিলো মায়াকে! মায়া ব্যথা পেলেও চুপ করে রইলো দাঁতেদাঁত চেপে!
শিহাব মায়াকে চেপে ধরে বললো,,
-আমার সাথে এতো হুজুরগিরী করতে আসিস না! জাস্ট বিরক্ত লাগে আমার এসব বুঝলি!
ছলছল চোখে শিহাবকে প্রশ্ন করে মায়া……
-আপনি তো সব জেনেশুনেই আমাকে বিয়ে করলেন! আপনি তো সব জানতেন!
তাহলে কেন এখন বিরক্ত লাগছে আপনার?
শিহাব চুপ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে!
শিহাবের চাহনি কি বলছে বুঝে যায় মায়া!
আজ মায়ার শরীর কিছুতেই সায় দিচ্ছে না!
তাই তো হালকা ধাক্কা দিয়ে শিহাবকে দূরে ঠেলে দেয়!
বিছানা থেকে উঠতে নিতে মায়ার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে শিহাব!
নিজেকে শিহাবের বাহু থেকে ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যায় মায়া!
বিরক্ত হয়ে শিহাব বলে,,,
-আমার সাথে এতো দেমাগ দেখাবি না! তোকে যে বিয়ে করেছি এটাই তোর জন্য অনেক!
তুই যে আমার বউ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিস আমার তোর প্রতি করুণা হয়েছে বলেই!
না হলে যার বাপ মায়ের ঠিক নাই তাকে বিয়ে করতো কে?
শিহাবের এমন কথায় মায়ার হাত থেমে যায়!
নিজেকে ছাড়ানোর আর চেষ্টা করে না সে!
চোখের অশ্রুগুলোতে বালিশ ভিজে যায় মায়ার! তারপর ও দয়া হয় না শিহাবের!
দিনের পর দিন শিহাবের অত্যাচারটা যেন মায়ার প্রতি বাড়তেই থাকলো।
জাহানারা বেগম এসব দেখে তৃপ্তির হাসি হাসেন! কারণ তিনি কখনোই চান নি মায়া তার ছেলের বউ হয়ে আসুক!
শিহাবকে মায়ার বিরুদ্ধে কথা বলে আরো বেশি তিনি উসকিয়ে দেন!
-আজ জুমাবার যান না আজ মসজিদে!
আমাদের তো আল্লাহর কাছে ফিরতে হবে!
আমি চাই আপনার সাথে জান্নাতে একসাথে থাকতে!
আল্লাদি কন্ঠে শিহাবকে বললো মায়া!
শিহাব মায়ার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললো,,
-তুই আমাকে এসব বলে লাভ কি বল?
আমি কি তোর কথা মানি কখনো।
-না না আমি আপনাকে আমার কথা মানতে বলছি না,,এটা তো আল্লাহর হুকুম আপনি কেন বুঝেন না!
শিহাব কিছু বলতে যাবে তখনি মেহরাব ভাইয়া বলে বাহিরে থেকে ডাক দেয়!
-কি হয়েছে ডাকছিস কেন?
-চলো ভাইয়া নামাজে যাবে না!
-না তুই যা আমার ভালো লাগছে না!
-ভাইয়া কি বলো! চলো তো নামাজ পড়লে এমনিতেই ভালো লাগবে চলো……
মেহরাবকে থামিকে দিয়ে রুক্ষভাবে বলে শিহাব,,
-বলছি না আমি যাব না! তুই যা।।
ভাইয়ের সাথে আর কথা বাড়ায় না মেহরাব!
মনে মনে শিহাবের জন্য হেদায়েত চেয়ে নেয় আল্লাহর কাছে!
অনেকক্ষণ পর রুমে আসে শিহাব,,এসে দেখে মায়া “কোরআন পড়তে বসে গেছে”
মায়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে শিহাব,,
-আমার জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আয় যা!
মায়া একপলক শিহাবের দিকে তাকিয়ে আবার কোরআন পড়তে শুরু করলো,,উদ্দেশ্য আয়াতটা শেষ করে যাবে! আয়াতের মধ্যখানে তো আর উঠা যায় না!
মায়ার এমন আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো শিহাব!
তার কাছে মনে হলো মায়া ইচ্ছে করেই তার কথা শুনে নি!
তাই তো মায়ার দিকে তেড়ে আসে মারতে!
মায়া আয়াতটা শেষ করে কোরআন বন্ধ করে চুমো দিচ্ছিলো তখনি শিহাব এসে মায়াকে কষে চড় মারে!
কোরআন বুকে চেপে ধরে হতভম্ভ হয়ে শিহাবের দিকে তাকায় মায়া!
ফের শিহাব মায়াকে জখম করে!
শিহাব মায়ার পিঠে খুব জোড়ে পাশে থাকা লাঠি দিয়ে বারি মারলো……
মায়ার কান্নার শব্দটা বেড়ে যেতেই নিজে মুখ চেপে ধরে!
মেহরাব নিজের রুমের দিকে যাওয়ার পথে মায়ার কান্না শুনতে পায়!
রুমের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রয় মেহরাব!
দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে দরজা ভেতর থেকে আটকানো।
মেহরাবের আর বুঝতে বাকি রইলো না ভাই যে আবার মায়ার উপর নির্যাতন করছে!
শিহাব ঠাস করে দরজা খুলে বাহিরে বের হয়!
ভাইকে দেখে মেহরাবের রাগটা বেড়ে যায়!
কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিহাব হনহন করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়!
মায়া ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা ঠুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছিলো!
মাথার হিজাবটা ছিড়ে মায়ার ফর্সা ঘারটা বেড়িয়ে গেছে,,,সেখানে কালচিটে দাগ বসে গেছে!
মেহরাব দরজার সামনে গিয়ে মায়ার অবস্থা দেখে ভেতর ভেতর ঢুকরে উঠে,,
সে চাইলেও কিছু করতে পারছে না মায়ার জন্য,,তার যে এই অধিকার নেই!
চোখের হেফাজতের কথা মনে হতেই মেহরাব চোখ নামিয়ে মায়াকে ডাকলো,,,
-মায়া……
ঝট করে পেছনে তাকিয়ে মেহরাবকে দেখতে পেয়ে পড়নে ছেড়া হিজাবটা দিয়ে শরীর ডাকার বৃথা চেষ্টা করে মায়া!
মেহরাব নিচের দিকেই তাকিয়ে বলে,,
-কেন সহ্য করছিস,,?
মায়া ভারী গলায় উত্তর দেয়,,
-আপনি এখান থেকে চলে যান মেহরাব ভাই!
এটা আমার আর আমার স্বামীর মধ্যকার বিষয়।
নীরবে চলে আসলো মেহরাব!
-মাটির মানুষ কেন হচ্ছো মায়াবতী! কেন প্রতিবাদ করছো না!
শিহাব ঘরে আসার পর মেহরাব ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চলে যায়!
মেহরাবকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে শিহাব,,
-দেখ তুই এখন আমাকে কোন জ্ঞানের কথা বলবি না এমনিতেই আমি ক্লান্ত হয়ে আছি!
তাচ্ছিল্যর স্বরে ভাইকে বলে মেহরাব,,
-হ্যাঁ ভাই ক্লান্ত তো হবিই নিজের সব শক্তি যে মেয়েটার উপর অত্যাচার করেই শেষ করে দিয়েছিস!
-ওহ! তোকে বলে দিয়েছে……
দাঁত কড়মড় করে শিহাব জিজ্ঞেস করে মেহরাবকে!
-তুমি হয়তো খেয়াল করো নি ভাই! ওকে মারতে নিজের কানে শুনেছি আমি।
আর ও আমায় বলবে?
হাসালে ভাইয়া! যে মেয়েকে আমি আজ পর্যন্ত ঠিকমতো দেখিনি যে মেয়েটি আমার সামনে আসে না,,সে মেয়েটি এসব বলবে আমায়?
-তো তর কি সমস্যা! আমার বউ আমি মারবো না হয় কাটবো তর এতো দরদ উতলিয়ে পড়ছে কেন!
-দরদ উতলাচ্ছে না ভাই! কষ্ট লাগে চোখের সামনে এইভাবে কাউকে মার খেতে দেখলে দিলে গিয়ে লাগে! ও তুমি বুঝবে না ভাই!
তোমার দিল বলে কিছু আছে বলে মন হয় না ভাই! আর “বউ” বললে না,,,সিরিয়াসলি ভাই তুমি ওকে নিজের স্ত্রী মানো?
মানলে তো এইভাবে পশুর মতো আচরণ করতে না!
শিহাব গর্জে উঠলো মেহরাবের এমন কথায়!
মেহরাব ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো,,
-গলার জোর দেখিয়ে সত্যটা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করো না ভাই!
হাদিসে কি এসেছে জানো ভাই……
“সেই উত্তর পুরুষ যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম”
তুমি কি তোমার স্ত্রীর কাছে উত্তম হতে পেরেছ ভাই?
-আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস?
-এইরকম সৌভাগ্য আমার নাই! তবে তোমার ভালো জন্যই কথাগুলা বললাম আল্লাহকে ভয় করো ভাই…!
মেহরাব এইটুকু বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো……
শিহাবের ফোন হঠাৎ বেজে উঠলো!
নাম্বারটা দেখে বিরক্ত নিয়ে কল রিসিভ করে বললো,,
-দেখ! আমি আর দেড়ি করতে চাই না! তাড়াতাড়ি যা করার কর! আমি ওকে জাস্ট সহ্য করতে পারছি না!
সৌন্দর্যের মোহে পড়ে ওকে বিয়ে করেছিলাম,,কিন্তু এখন ওকে জাস্ট একদম সহ্য হচ্ছেনা!
ওর কোন কিছুই আমার সাথে যায় না,,থার্ডক্লাস মেয়ে কোথাকার!
আমি মাইশাকে কথা দিয়ে ফেলেছি! এখন তাড়াতাড়ি তুই পেপারগুলা রেডি করে আমায় বলবি,,রাখছি!
ফোন কাটতেই মায়া এসে শিহাবের সামনে দাঁড়ালো,,হাতে এক কাপ চা!
শিহাবের দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বললো মায়া,,
-আ…আপনার চা!
মায়ার হাত থেকে চা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো শিহাব!
শিহাব যেতেইই মুখ চেপে ঢুকরে কেঁদে উঠলো মায়া!
মেহরাব মায়ের রুমের সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে বললো,,
-আসতে পারি মা!
জাহানারা বেগম ছেলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন,,
-অনুমতি নেওয়ার কি আছে? আয়!
মুচকি হেসে মায়ের কথার জবাব দিতে গিয়ে বললো মেহরাব,,
-অনুমতি নেওয়াটা আল্লাহই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন মা!
আল্লাহ বলেন__
“বিনা অনুমতিতে পিতামাতার ব্যক্তিগত ঘরে প্রবেশ করো না”। [সূরা নূর ২৪:৫৮]
জাহানারা বেগম কথা ঘুরিয়ে বললেন,,
-মেহরাব তোর চেহারার এ কি অবস্থা করেছিস!
মুখে দাড়ি রেখে জঙ্গল করে রেখেছিসস কেন?
আজ সেইভ করে আসিস!
মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,,
-দাড়ি নবীর সুন্নত মা!
আর দাড়ি রাখলে আল্লাহ খুশী হোন!
এটা তাকওয়ার অবলম্বন!
জাহানারা বেগম ছেলের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,,
-তুই তো এইরকম ছিলি না রে! তাহলে হঠাৎ করে হুজুরী কথাবার্তা কেন বলছিস?
মেহরাব মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকে!
জাহানারা বেগম ছেলের মনের অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোন!
ছেলের দিকে তাকিয়ে সংকুচিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন জাহানারা,,
-তোর কি হয়েছে মেহরাব!
মায়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে মেহরাব,
-আমার কিছু হয় নি মা!
তোমার ছেলের কি হয়েছে একটু জিজ্ঞেস করবে?
ও না কি মায়াকে ডিভোর্স দিতে চায়!
কেন করছে মা ভাইয়া এসব!
ও ই তো মায়াকে নিজ ইচ্ছেতে বিয়ে করলো!
মেহরাবের এমন কথায় নড়েচড়ে বসলেন জাহানারা!
ছেলের এমন কথায় কিছুটা বিস্মিত হলেন তিনি!
মেহরাব বলতে লাগলো,,
-মায়ার কি দোষ বলবে মা!
সারাদিন মেয়েটা এই সংসারে খেটে মরে তারপর ও কারো মন পায় না!
আর দিন শেষে ভাইয়া ওর ওপর নির্মম অত্যাচার করে!
তুমি ও হয়তো শুনেছো মা ভাইয়া ওকে কিভাবে মারধর করে!
তুমি কিছু ভাইয়াকে বলছো না কেন মা?
মেহরাব মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকায়!
জাহানারা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,,
-তুই এতো চিন্তা কেন করছিস! ওর স্বামী ওকে মারবে না কাটবে আমাদের কি!
আর আমরা কেনই বা ওদের মাঝে যাব?
ও ভুল করে তাই মার খায়!
এখানে দোষের কি?
মায়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহরাব বলে,,
-দোষ কার দোষ দিচ্ছো মা!
মায়ার! হাহ
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়ের পাশ থেকে উঠতে উঠতে বলে মেহরাব……
-আমি কালকের ফ্লাইটেই সুইডেন চলে যাচ্ছি!
আজ রাতেই রওয়ানা দিবো!
-হঠাৎ করেই চলে যাবি যে!
-এখানে থেকে কি করবো মা! চোখের সামনে অমানুষী আচরণ দেখতে কষ্ট হয়!
এর থেকে দূরে গিয়ে পড়ে থাকি! ভালো থাকবো!
মায়ের রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায় মেহরাব!
এশার নামায পড়ে কোরআন নিয়ে বসলো মায়া!
মসজিদ থেকে এসে মায়ার গুণগুণ করে কোরআন পড়তে শুনে মেহরাব!
মায়ার রুমের দরজায় গিয়ে হাক দেয় মেহরাব,,
-মায়া একটু শুনবে?
কোরআন বন্ধ করে নীরব থাকে মায়া!
মেহরাব বলতে শুরু করে,,
-আজ চলে যাব! দোয়া করি ছোট্ট মায়াপরী ভালো থাকুক!
মায়া সুরা হা-মিম সিজদাতে একটি আয়াত আছে, যার সারমর্ম মোটামুটি এরকম,
উত্তম কিছু দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করুন। দেখবেন,আপনার সাথে যার শত্রুতা রয়েছে, সেও হয়ে যাবে যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু। – আয়াত নং ৩
আয়াতটা কেন বললাম বুঝতে পারছো মায়া!
তাই চেষ্টা করো ইনশাআল্লাহ আল্লাহ সব সহজ করে দিবেন!
মেহরাবের কথা শুনে মায়ার চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়তে থাকে!
কোরআন বুকে ধরে মুখ চেপে কান্না করে মায়া!
মেহরাব নিজের রুমের দিকে হাটা ধরে!
আজ রাতে শিহাব বাড়ি ফিরে নি!
টেবিলে খাবার নিয়ে সারাটা রাত শিহাবের অপেক্ষা করেছে মায়া!
কিন্তু শিহাবের আসার কোন নাম নেই!
শেষ রাতে তাহাজ্জত পড়ে অনেক কেঁদেছে মায়া!
শিহাবের হেদায়েতের দোয়া চেয়ে সিজদায় মাথা নুইয়ে রেখেছিলো মায়া!
সকাল ১০ টার দিকে শিহাব বাড়ি ফিরে!
শিহাবকে দেখে মায়া সালাম দিয়ে এগিয়ে যায়!
মায়াকে এগিয়ে আসতে দেখে শিহাব নিজের হাততুলে বলে,,
-থামো! কাছে আসবে না!
মায়ার পা দুটো থেমে যায়!
শিহাব বিরক্তি নিয়ে রুমে চলে যায়!
রান্নাঘরে শিহাবের জন্য খাবার আনতে চলে যায় মায়া!
নাস্তার প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকে শিহাবকে কিছু কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া!
মায়ার দিকে তাকিয়ে হাতের কাগজগুলো এগিয়ে দেয় শিহাব!
টেবিলে নাস্তা রেখে শিহাবের হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে পড়তেই কেপে উঠে মায়া!
মায়া কথা বলার আগেই শিহাব বলে,,
-এই কাগজগুলাতে সাইন করে দে!
কাপাকাপা কন্ঠে মায়া উত্তর দেয়……
-এ…এসব কি বলছেন আপনি?
আ…আমি কি দোষ করেছি!
-দেখ বেশি কথা বাড়াস না!
যা বলছি তাই কর!
মায়া নিজেকে সামলে নিয়ে শিহাবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়!
মায়ার দিকে বিরক্তিকর মুখ নিয়ে তাকায় শিহাব!
শিহাবের ডান হাতটা টেনে নিয়ে নিজের পেটে রাখে মায়া!
শিহাব হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে মায়া শক্ত করে নিজের পেটে শিহাবের হাত আঁকড়ে ধরে বলে,,
-কিছু অনুভব হচ্ছে না আপনার!
আপনার রক্ত আপনার সন্তান আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে!
আমি জানি আপনি কেন আমায় ডিভোর্স দিতে চাইছেন! আমি এও জানি আপনি পরকিয়ায় লিপ্ত এবং সেটা কালই জেনেছি আমি!
আমি আপনাকে কৌশলে বুঝাতে চেয়েছি আপনি যেটা করছেন সেটা পাপ!
কিন্তু আপনি বুঝতে পারেন নি!
আমি আজ আপনাকে সরাসরি বলবো,,
“দয়া করে আপনার যাকে পছন্দ তাকে বিয়ে করুন”
আপনার দ্বিতীয় বিয়েতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না!
দয়া করে আপনি আমায় আপনার থেকে আলাদা করে দিয়েন না,,আমি এককোনে পড়ে রইবো!
আমি আপনাকে বাধা দিবো না!
আমি বিয়ে করতে চান করতে পারেন আমি কিচ্ছু বলবো না আপনাকে!
আপনার এই সন্তানের জন্য অত্যন্ত আমাকে জায়গা দিন,,দয়া করুন আমায় উপর!
শিহাব মায়ার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঝট করে মায়ার হাত থেকে ডিভোর্স পেপার নিয়ে বাইরে চলে গেলো!
শিহাবের এমন আচরণে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়া!
ছাদে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমত বৃষ্টিতে ভিজছে মায়া!
আজ অনেক দিন পর বৃষ্টিতে ভেজা হচ্ছে!
-আম্মু আম্মু আমিও ভিতবো,,আব্বু আব্বু!
মেয়েকে বুকের সাথে লেপ্টে ধরে মেহরাব!
-আব্বু চালো চালো আমি ভিতবো!
মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে মেহরাব!
-আম্মু তোমার অসুখ হবে!
-তাহলে আম্মুল ও অতুত হবে,,আম্মুকে নিয়ে আতো!
মেহরাব হেসে বললো,,
-হুম নিয়ে আসছি আম্মু!
তুমি দাদুর কাছে যাও!
মেহরাব মেয়েকে জাহানারা বেগমের কাছে দিয়ে মায়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো!
মায়া চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির পানির ছোঁয়া নিজের শরীরে নিচ্ছে!
মেহরাব মায়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো!
আস্তে আস্তে মায়া নিজের চোখ খুলে মেহরাবের বাহুডরে নিজেকে আবদ্ধ দেখতে পেলো!
মায়ার মুখে ছড়িয়ে পড়া চুল আস্তে করে কানের পাশে গুঁজে দিলো মেহরাব!
মায়া মুচকি হেসে মেহরাবের বুকে মাথা রাখলো!
মেহরাব স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,,
-আজ বিয়ের দুই বছর পর তুমি আমার বুকে নিজ ইচ্ছেতে মাথা রাখলে মায়াবতী!
মায়া মেহরাবের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,,
-উনার মৃত্যুর আজ ৩ বছর হলো তাই না!
মায়ার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বললো মেহরাব,,
-ধৈর্য ধরো মায়াবতী!
তুমি ধৈর্যহারা হলে এই পরিবারটাও যে ভেঙ্গে যাবে!
মায়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,,
-জানেন! সেদিন উনি আমার কাছে মাফ চেয়েছিলেন,,আর খুব কান্নাও করছিলেন সেদিন!
ডিভোর্স পেপার নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর উনি হাতে আগুন নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলেন।
আর আমার সামনেই তালাকনামাটা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন!
যেদিন আমার পেইন উঠলো ওইদিন উনার মুখটা খুবই বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিলো!
সেদিন বুঝতে পেরেছি উনি কতোটা ভালোবাসেন আমায়!
দেখুন না আমাকে বাঁচাতে আমার রক্তের খুঁজ করতে গিয়েই উনি মৃত্যুর মুখে চলে গেলেন!
আমিই দায়ী উনার মৃত্যুর জন্য!
উনি না খুব ভালো ছিলেন!
বৃষ্টির পানিতে মেহরাবের চোখের জলগুলা মিশে যেতে লাগলো!
মেহরাবের পাঞ্জাবী আঁকড়ে ধরে ঢুঁকরে কেঁদে উঠে মায়া!
অজ্ঞান মায়াকে বিছানায় শুইয়ে কাপড় পালটে দেয় মেহরাব!
মায়ার মেয়ে ছোট্ট মাইশারা এসে মায়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে!
মেহরাব মাইশারাকে পরম আদরে আঁকড়ে ধরে বলে,,
-আম্মু তোমার মা অসুস্থ! তুমি আমার কোলে এসো আব্বু!
মেহরাবের কোলে লাফিয়ে উঠে মাইশারা!
মেয়ের মাথায় চুমো দিয়ে মায়ার পাশে বসে মেহরাব!
জাহানারা বেগম গরম তেলের বাটি নিয়ে রুমে ঢুকেন!
মায়ের হাত থেকে তেলের বাটি নিয়ে মায়ার পায়ের পাশে বসে পায়ে তেল ঢলতে থাকে মেহরাব!
জাহানারা বেগম মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে মাইশারাকে নিয়ে চলে যান!
প্রায় আধঘণ্টা পর মায়ার জ্ঞান ফিরে!
মেহরাবকে পায়ের পাশে বসতে দেখে নিজের পা গুটিয়ে নেয় মায়া!
মায়ার জ্ঞান ফিরেছে দেখে মায়ার মাথার পাশে গিয়ে বসে মেহরাব,,
মায়া তাকিয়ে বলে,,
-আমার মেয়ে!
-মেয়েটা কি শুধু তোমারই মায়া! আমার ও তো মেয়ে!
মায়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ে!
মেহরাব মায়ার হাত শক্ত করে ধরে বলে,,
-আমিও ওর বাবা হতে চাই মায়া!
-আমার মেয়েটাকে একটু এনে দিন!
ছলছল চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে মেহরাব,,
-মায়াবতী……
-আমার ভালো লাগছে না!
চোখের কোনের জল মুছতে মুছতে উঠে মায়ার পাশ থেকে উঠে যায় মেহরাব!
-কখন তুমি আমার মন থেকে মেনে নিবে মায়াবতী!
তুমি আমায় তোমার শরীরটা দিয়ে দিলেও তোমার মনটা আমি পেলাম না মায়াবতী!
আমি তোমার এই শরীর চাই না মায়াবতী,,কেন বুঝো না তুমি?
ভাইয়ার মৃত্যুতে কষ্টটা আমিও পেয়েছি!
আমি ভাবতে পারিনি ভাইয়া এইভাবে মারা যাবে!
আমি তোমার আর ভাইয়া দাম্পত্য জীবনের সুখের জন্য সবসময় দোয়া করতাম!
কিন্তু নিয়তি………
মাইশারাকে এনে মায়ার কোলে দিয়ে বারান্দায় চলে গেলো মেহরাব!
বৃষ্টির পর প্রকৃতিটা নতুন রূপে সেজেছে!
চারিদিকের পরিবেশটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে,,স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছে চারপাশ,,!
আয়াতটা মনে হতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুললো মেহরাব,,,
“তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ু পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানিপূর্ন মেঘমালা বয়ে আনে,
তখন আমি এ মেঘমালাকে একটি মৃত শহরের দিকে পাঠিয়ে দেই। অতঃপর এ মেঘ থেকে বৃষ্টি ধারা বর্ষণ করি। অতঃপর পানি দ্বারা সব রকমের ফল উৎপন্ন করি। এমনি ভাবে মৃতদেরকে বের করব-যাতে তোমরা চিন্তা কর।” (সূরাহ আল-আরাফ, আয়াত : ৫৭)
ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে মেহরাবের পিটে কেউ স্পর্শ করলো!
পেছনে তাকিয়ে মাইশারাকে মায়ার কোলে দেখে মুচকি হাসলো মেহরাব!
ছোট্ট মাইশারাকে মুচকি হেসে বললো মায়া,,
-আম্মু তোমার আব্বুকে একটু বকে দাও তো!
-কেন আম্মু!
-তোমার আব্বু আম্মুর সাথে রাগ করেছে!
-আব্বু তুমি মায়েল তাতে লাগ কললে কেন?
মেহরাব মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আলতো করে মাইশারাকে ধরে বললো,,
-ভুল হয়ে গেছে আম্মু! আর আব্বু রাগ করবো না!
-আম্মু আব্বু লাগ কববে না!
মায়া মুচকি হেসে বললো,,
-তাহলে আব্বুকে একটা পাপ্পি দিয়ে দাও তো!
মাইশারা মেহরাবের গালে চুমো দিয়ে লাফিয়ে বাবার কোলে চলে গেলো!
মেয়েকে পরম আদরে আঁকড়ে ধরে আনন্দাশ্রু নিয়ে মায়ার দিকে তাকালো মেহরাব!
মুচকি হেসে মেহরাবের কাদে মাথা রাখলো মায়া!
★সমাপ্ত ★
[ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন ]