আব্দুল মালেক চাচা গ্রামের গণ্যমান্য ব্যাক্তি । গ্রামের সবাই তাঁকে গুরুজন হিসেবেই মানে । তাঁর একমাত্র নাতনিকে একজন দ্বীনদার পাত্রের হাতে তুলে দেওয়াই এখন তাঁর একমাত্র কাজ ।
তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতের সাথেই আদায় করেন । মসজিদের ইমাম সাহেবের তিলাওয়াতের কণ্ঠে তিনি বিমুগ্ধ ।
অল্প বয়স্ক ইমাম , নূরানি চেহারা , মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি । যেন পুরাে চেহারা জুড়ে নূরের ঝলকানি ।
একদিন নামাজ শেষে তিনি মসজিদে বসেবসে তাসবিহ পড়ছিলেন আর ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন । মসজিদ লােকশূন্য হওয়ার পর তিনি ইমাম সাহেবের ঠিক সামনে গিয়ে বসলেন । ইমাম সাহেবের হাত ধরে বললেন , “ বাজান , তােমার নাম কী ?
‘ আমার নাম মাহমুদুল হাসান ।
‘ ভারি সুন্দর নাম তাে ! তা বাজান তােমার বাড়ি কোনহানে ?
‘ আমার বাড়ি এইতাে পাশের গ্রামে ।
তােমার আব্বা কি কাম করে বাজান ? ”
‘ আমার আব্ব একজন ব্যবসায়ী ।
মেশিনারি পার্টস – এর ব্যবসা করেন ।
‘ বাজান ,
তােমারে একখান কতা কইলে তুমি কি রাগ করবা ?
” না না চাচা , রাগ করবাে কেন , আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন ।
‘ তুমি কি বিয়াশাদী করছাে বাজান ?
না চাচা , এখনও বিবাহ করিনি ।
‘ চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আব্দুল মালেক চাচা বললেন ,
“ বাজানরে , আমার একটা নাতনি আছে মেলা সুন্দরি । কিন্তু বাজান নামাজ কালামের ধার ধারে না । সারাদিন টিভি দেখে আর বান্ধবীগাে লগে আড্ডা মারে । তােমার তিলাওয়াত শুইনা আর তােমার ব্যবহার দেইখা আমি খুশি হইয়া গেছি ।
বাজান । আমার মেলা ইচ্ছা আমার নাতনিডারে তােমার লগে যদি বিয়া দিতে পারতাম ! আমার বদ মেজাজি নাতনিডারে বিয়া করবা বাজান ?
মাহমুদ হতভম্ভ হয়ে চুপ করে রইলাে । চাচা মাহমুদের চুপ থাকা দেখে বললেন ,
‘ কী হইলাে বাজান চুপ কইরা আছাে যে ? ‘
চাচা , আমি আমার আব্দুর সাথে কথা বলে জানাবাে । এখন হুঠহাট করে কোনাে সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না ।
মাহমুদ বাসায় এসে চিন্তায় পড়ে গেল । এরকম বদ মেজাজি মেয়েকে নিয়ে সংসার করবাে কী করে ! আবার মুরুব্বী লােকটার জন্যও খারাপ লাগছে । সব মিলিয়ে মাহমুদ খুব চিন্তিত । মাহমুদ সব কথা তার বাবাকে খুলে বালল। মাহমুদের বাবা মাসউদুর রহমান খুবই ভদ্র একজন মানুষ । তিনি ছেলেকে বললেন , তুমি কিছুদিন চিন্তা করাে , ইস্তেখারা করাে ।
দেখাে । ফলাফল আসে ।
মাহমুদ ইস্তেখারা করে কয়েকদিন চিন্তা – ভাবনা করে ওর বাবাকে বলল , ‘ আব্ব , আমি চিন্তা করে যা পেয়েছি সেটা হলাে- যদি একজন আন্দ্রা মডার্ন মেয়েকে দ্বীনের পথে আনতে পারি তাহলে এটাই হবে আমার জীবনের সবচে বড় অর্জন ।
আর ইস্তেখারা করে আমার মন কিছুটা ঝুঁকেছে ।
এখন আপনার মতামতের উপর ছেড়ে দিলাম ।
‘ আলহামদুলিল্লাহ !
যদি তােমার মন ঝুঁকে যায় তাহলে আমার আপত্তি নেই । তবে মেয়ের পরিবার ও মা কেমন ? তাদের পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের আচরণ কেমন এগুলাে একটু যাচাই করা দরকার । ‘ পরদিন মাহমুদের সাথে আব্দুল মালেক চাচার দেখা হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন , বাজান , তােমার আব্বার কাছে কইছাে ব্যাপারখানা ?
জি চাচা বলেছি । আব্রু আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন ।
আর আম্মু আর আমি সামনের শুক্রবারে ইনশাআল্লাহ আপনার নাতনিকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি । যদি আম্মুর পছন্দ হয় তাহলে আমরা সেদিনই বিবাহ পড়িয়ে উঠিয়ে নিয়ে আসবাে । কোনাে অতিরঞ্জিত আয়ােজন করবেন না ।
সাদামাটাভাবেই সবকিছু হবে ।
সুন্নাহ অনুযায়ী হবে ।। চাচা খুশিতে কান্না করে দিয়ে বললেন , ‘ আজ আমি মেলা খুশি । তােমার মতাে একজন মানুষের হাতে আমার নাতনিডারে তুইলা দিয়া আমি মইরাও শান্তি পামু । ‘ তিনি বাড়ি গিয়ে ছেলে ও বউমাকে ডেকে নাতনির বিবাহের কথা তুললেন । কেউ তার মুখের উপর কথা বলতে পারে না ।
তার ছেলের ইচ্ছা হলাে , মেয়েকে বড় ইঞ্জিনিয়ার কিংবা চাকরিজীবী ছেলের হাতে তুলে দেবেন ।
চিরকুট
ফাতিমা আফরিন
কিন্তু বাবার কথার উপর কথা বলার সাহস তার নেই । অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার কথায় রাজি হয়ে গেল । কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালাে নাতনি সাবিহা নওরিন । সে কিছুতেই হুজুর ছেলেকে বিয়ে করবে না।
তার ধারণা হুজুররা আনস্মার্ট , বােকাসােকা , অসামাজিক । নওরিন বদমেজাজি ঠিক , কিন্তু দাদার কথার উপর কথা বলার সাহস পেল না ।
ঘােরবিরােধী হওয়া সত্ত্বেও চুপচাপ মেনে নিলাে দাদার কথা । নওরিন নাওয়া – খাওয়া ছেড়ে সারাদিন ঘরের দরজা আটকে কাঁদতে থাকে ।
পাড়ার বান্ধবীরা এসে টিপ্পনী কেটে বলে , কিরে নওরিন , শেষমেশ একজন মােল্লা বেছে নিলি ? হুজুরদের কেমম যেন দাদা দাদা লাগে । অল্প বয়সেই দাদার ভাব ধরে ।
আর কোনাে ছেলে খুঁজে পেলি না ? নওরিন ঝাঁঝালাে কন্ঠে বলল , দেখ ! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে আসিস না । এমনিই মন – মেজাজ ভালাে না , তারপর উপর এসব কথা ভাল লাগছে না । আমার পরিবার যদি আমাকে নরকে ফেলে শান্তি পায় , পাক ।
কোনাে কথা বলবাে না । তবে ওই ব্যাটারে সাইজ না করে আমি ছাড়ছি না । কী দরকার ছিল আমাদের এলাকায় এসে ইমামতি করার ! আমার দাদাও ওই খ্যাতটাকেদেখে একদম দিওয়ানা হয়ে গেছে । তােরা এখন যা তাে , আমাকে একটু একা থাকতে দে। নওরিনকে সাজুগুজু করিয়ে বরপক্ষের সামনে আনা হলো ।
নওরিন । চুপচাপ বসে চোখের পানি ঝরাচ্ছে । মাহমুদ সালাম দিল , নওরিন কোনাে উত্তর না দিয়ে মুখটা ভার করে বসে আছে । সালামের উত্তর না পেয়ে মাহমুদ বলল , আচ্ছা আপনি এবার যেতে পারেন । নওরিন যেন হাফছেড়ে বাঁচলল । ওর মনের আশাটা পূর্ণ হয়েছে , তার ধারণা ছেলে পক্ষ তার এমন আচরণে বিবাহ না করে চলে যাবে । কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল তার উল্টো হয়েছে ।
মাহমুদ তার আম্মুকে বলল , ‘ আম্মু , আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করবাে , এবং তাকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনবাে ইনশাআল্লাহ ! মাহমুদের আম্মু বলল , ‘ বাবা , তুমি পারবে তাে ? এটা একটা বড় পরীক্ষা ! ‘ আম্মু তুমি চিন্তা কোরাে না । ইনশাআল্লাহ আমি পারবাে । আল্লাহ আমার । সাথে আছেন । এরপর নওরিনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাহমুদের সাথে বিয়ে হয়ে গেলাে ।
নওরিন চুপচাপ বসে নীলাকাশ দেখছে , তার পরিণতির কথা ভাবছে । শেষ পর্যন্ত একজন মােল্লাকে বিয়ে করতে হলাে ওর ! কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না নওরিন ।
মাহমুদ সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলাে । নওরিন কোনাে উত্তর না দিয়ে চড়া গলায় বলল , এই যে দেখুন !
আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে ঠিক , কিন্তু কোনােপ্রকার আদিখ্যেতা দেখাতে আসবেন না । এই বিয়েতে আমার একটুও মত ছিল না । দাদার জন্য বিয়েটা করতে হলাে । আমি আপনার মতাে মােল্লার সাথে সংসার করতে পারবাে না । আপনি আমার থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন । ‘ মাহমুদ শান্ত গলায় বলল , “ আচ্ছা , আপনি যতদিন চাইছেন না , ততােদিন আমি দূরেই থাকবাে ।
‘ যতিদিন চাইছি না মানে ? আমি কোনােদিনই চাই না । তবে আপনি যদি আমার একটা উপকার করেন তাহলে অনেক কৃতজ্ঞ থাকবাে । “ বলুন কী উপকার করতে পারি ? ”
“ আপনি আমার জন্য একজন চাকরিজীবী ছেলে ঠিক করুন । মাহমুদ জোরে হেসে উঠলাে । মাহমুদের হাসি দেখে নওরিনের ব্লগ চরমে উঠে গেল । দাঁত কটমট করতে করতে বলল , এই যে শুনুন ! এভাবে পিশাচের মতাে হাসবেন না । ‘
‘ আচ্ছা হাসবাে না । আমার খুব ঘুম পাচ্ছে । অন্তত ঘুম তাে পড়তে দিন । শরীরটা খুব ক্লান্ত ।
‘ তা ঘুমান , তবে আমার সাথে ঘুমাবেন না ।
ফ্লোরে ঘুমান । ‘ মাহমুদ কথা না বাড়িয়ে ফ্লোরে বিছানা করে শুয়ে পড়লাে । নওরিনের চোখে ঘুম নেই দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না ।
কীভাবে এই মােল্লার সংসার করবে সে ! সমাজ তাকে ছিঃ ছিঃ করবে । সমাজের চোখে নওরিনকে করুণার পাত্রি হয়ে বাঁচতে হবে ।
লােকে বলবে , শেষ পর্যন্ত একটা মােল্লাকে বেছে নিলি ? মােল্লাদের কী আছে , বাড়িঘর কিছুই নেই , সারাজীবন অন্যের দরজায় দরজায় ঘুরে – ঘুরে দাওয়াত খেয়ে বেড়ায় । নাহ । আর এসব ভাবতে পারছে না । ফজরের নামাজ আদায় করে এসে দেখে নওরিন এখনও ঘুমে । নওরিনকে না ডেকে নাশতা বানিয়ে রুমে ঢুকে নওরিনের কানের পাশে একটি ইসলামিক সংগীত ছেড়ে দিয়ে নিচে চলে আসলাে মাহমুদ ।
নওরিন সংগীতের আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠে পড়লাে । ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে দেখে ৮,৩৫ বাজে ।
দ্রুত ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে দেখলাে নাশতা সামনে রেখে মাহমুদ ডাইনিং টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। নওরিন নাশতা না করে সােজা উপরে এসে আবার শুয়ে পড়লাে ।
খাদেমা খালার ডাকে মাহমুদের ঘুম ভেঙ্গে যায় । নাশতা সেরে মাদরাসায় । চলে যায় মাহমুদ । এদিকে নওরিন না খেয়ে জেদ ধরে শুয়ে আছে ।
খাদেম এসে নওরিনকে ডেকে বলল , “ ভাবিসাব আয়ে অহনাে ঘুমেত্তে উডেন নাই ?
চিরকুট
ভাইসাব তাে সেই কোন সুমায় চইল্লা গেছে । আহেন নাশতা খাইয়া যান । আরে শাশুড়ি যদি জানে আন্নে নাশতা না খাইয়া শুইয়া রইছেন তালিপরে । আমার কপালে শনি আছে । আইচ্ছা ভাবিসাব , আম্নের মনডা কি অনেক খারাপ ? হারাদিন দেহি মনমরা হইয়া থাকেন ।
‘ খাদেমার কথা শুনে নওরিনের খুব রাগ হচ্ছে । কিছু বলতে যাবে । এমনসময় ওর মনে হলাে , যাে রাগ সব তাে মাহমুদকে ঘিরেই । শুধুশুধু খাদেমার সাথে রাগ করে কী লাভ ! এসব ভেবে নিচে এসে নাশতা খেয়ে নিলাে । টেবিলের উপর একটি চিরকুট পেয়ে হাতে নিয়ে বিরক্তির সাথে পড়তে লাগলাে
“ নাশতা খেয়ে নিও ।
খাদেমা আসতে দেরি হয়ে গেছে তাই নিজেই নাশতা বানিয়ে তােমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । জানি , আমার হাতের নাশতা তােমার পছন্দ হবে না । নাশতা খেয়ে আমাকে গালাগাল কোরাে না । ইতি- তােমার মাহমুদ ।
” নওরিন চিরকুটটা ছিড়ে কুটিকুটি করে মিনমিনিয়ে বলল , কীহ ! আমার মাহমুদ ! নেকামাে যত্তসব । আমার দাদা যে কেন এই জোকারটার গলায় । আমাকে ঝুলিয়ে দিলাে !
মুখভর্তি জঙ্গলের মতাে একগােছা দাড়ি , বুড়ােদের মতাে আলখাল্লা পাঞ্জাবী পরে জোকার সেজে থাকে সারাদিন । আমি নাকি তার বউ ! অসম্ভব ! এটা আমি মেনে নিতে পারবাে না ।
কিন্তু জোকারটার হাতের লেখা এতাে সুন্দর ! ‘ নওরিন পরক্ষণেই আবার মুখে ভেঙচি কেটে বলল , ক্ষ্যাতটার আর যাইহােক হাতের লেখাটা বেশ সুন্দর । হাতের লেখার মতাে নিজেকেও যদি একটু স্মার্ট বানাতাে !
একমাত্র পুত্রবধূ নওরিনকে তার শ্বশুর – শাশুড়ি মেয়ের স্থানে বসিয়েছে । শাশুড়ি নওরিনকে পাশে বসিয়ে বলল ,
‘ মা , তােমার সাথে আমার কিছু কথা আছে । নওরিনের মন – মেজাজ ভালাে নেই । শাশুড়ির মুখের উপর বলে দিলাে , আমার এখন ঘুম পাচ্ছে ,
কথা শুনার সময় নেই । ‘ নওরিনের ঝাঁঝালাে কণ্ঠ শুনে কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন তিনি । পুত্রবধূর এমন আচরণে খুব কষ্ট পেলেন মাহমুদের আম্মা ।
ছেলে মাদরাসা থেকে ফিরে সােজা মায়ের ঘরে গিয়ে সালাম দিল । সালামের উত্তর দিয়ে । মাহমুদের আম্মা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ছেলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন ।
মায়ের চোখে পানি দেখে মাহমুদ বলল , ‘ একি ! আম্মা আপনি কাঁদছেন কেন ? ‘ ‘ কই না তাে ! চোখে মনে হয় কিছু পড়েছে ।
মাহমুদ মায়ের মুখে দু’হাত দিয়ে আলতাে করে ছুঁয়ে বলল , ‘ আম্মা , আমি এখন আর সেই ছােট্টটি নেই , অনেক বড় হয়ে গেছি । ‘ মাজেদা বেগম আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন , ‘ জানি তাে বাবা ! আমার ছােট্ট মাহমুদ এখন অনেক বড় হয়ে গেছে ।
তাের কথা ভেবেই চোখে । পানি এসে গেলাে । মাহমুদ বিস্মিত হয়ে বলল , ‘ আমার কোন কথা ভেবে ভেবে কাঁদছেন । আম্মা ?
এই যে আমার ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে । তাকে একটা বউ এনে দিলাম ! ভাবছি বউটা আমার ছেলের সাথে ভালাে আচরণ করবে তাে ! ‘
এমন কথা কেন বলছেন আম্মা । কিছু হয়েছে ? ‘
‘ না বাবা , কিছু হয়নি । তবে নওরিনকে বলেছিলাম , তােমার সাথে কিছু কথা আছে । কিন্তু তার ঘুম পাচ্ছিল ,
আমার কথা শুনার সময় নেই তার । নতুন বউ , সবেমাত্র এলাে । এখনই এমন আচরণ করছে তাহলে সামনে কেমন হবে সেসব ভেবেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি । আমার ছেলের জীবন কিভাবে কাটবে । মাহমুদ শান্ত গলায় বলল , ‘ চিন্তা করবেন না আম্মা । সব আমার উপর ছেড়ে দিন ।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে গিয়ে দেখে নওরিন বসে বসে মােবাইল টিপছে । সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করলাে । নওরিন সালামের উত্তর দিয়ে মােবাইল রেখে শুয়ে পড়লাে ।
মাহমুদও কথা না বাড়িয়ে নিচে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাে । নওরিন শােয়া থেকে উঠে জানালার গ্রিল ধরে রাতের আকাশ দেখছে । আজ রাতের আকাশে চাঁদ নেই । আমাবস্যার চাঁদরে ঢেকে আছে পুরাে শহর । কোলাহল মুক্ত পরিবেশ ।
নওরিন উদাস হয়ে ভাবছে , কেন আমার পরিবার আমার চাওয়া – পাওয়ার মূল্য বুঝলাে না ! আমার জীবনকে তারা মূল্যহীন করে দিল । বন্ধুমহলে মুখ দেখাবাে কীভাবে আমি ? কী ভাববে সবাই ? রাগে কটকট করতে করতে ঘুমিয়ে গেল ।
ঘুম থেকে উঠে দেখে বালিশের পাশে একটি কাগজের টুকরাে । চোখ কচলাতে কচলাতে কাগজটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারল নিশ্চয় মাহমুদ আবার কিছু লিখে রেখে গেছে । চিরকুটটা না পড়ে জাজিমের নিচে রেখে দিল ।
মাহমুদের আম্মা মাজেদা বেগম আবার নওরিনের কাছে গেলেন , পাশে বসলেন । নওরিনের হাত ধরে বললেন , ‘ তুমি আমার পুত্রবধূ নও , তুমি আমার মেয়ের মতাে । আমি তােমাকে মেয়ের স্থানে বসাতে চাই । সবসময় মন খারাপ করে থাকো কেন ? আমাদের কারাে কথায় কষ্ট পেয়েছে ? ‘
“ না আম্মা ।
‘ ‘ মাহমুদ কিছু বলেছে ?
“ না । ” ‘
তাহলে সারাদিন মন খারাপ করে থাকো কেন ? ‘ নওরিন কোনাে কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে । শাশুড়িকে তার অপছন্দের কথা বলতে পারে না । মাজেদা বেগম নওরিনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল , ‘ মা ! এই জগত সংসার বড় বিচিত্রময় । যদি তুমি সহজ মনে করাে , তাহলে পানির মতাে সহজ । যদি তুমি জটিল বানিয়ে ফেল তাহলে অনেক কঠিন এই জীবনপ্রবাহ । আমাদের ছােট্ট সংসার ।
গােয়ালভরা গরু নেই , মাঠভরা ধান নেই । তােমার সাহায্যের জন্য খাদেমা তাে আছেই । তবুও সারাদিন তােমার মন খারাপ দেখে আমরা ভাল থাকতে পারি ? নওরিন শাশুড়ির কথা শুনে যাচ্ছে ।
কোনাে কথা বলছে না । মাজেদা বেগব নওরিনের চুপচাপ থাকা দেখে কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন । বসে বসে তিনি ভাবছেন , আমার সংসারে আবার সুখ ।
ফিরে আসবে তাে ! সাজানাে সংসারটি তছনছ হয়ে যাবে না তাে ! মেয়েটাকে এতাে সুন্দর করে বুঝলাম , তার অন্তর একটুও নরম হলাে না ? মাহমুদ কেন । এই মেয়েকে বিয়ে করতে গেল ! বদমেজাজি মানুষ ভালাে হতে অনেক সময় লাগে ।
মাহমুদ জামাকাপড় গুছাতে গুছাতে বলল , “ নওরিন , গুছিয়ে নাও তােমাদের বাড়িতে যেতে হবে । দাদাভাই ফোন করে বলল , তােমাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসতে ।
নওরিন ভ্রু কুঁচকে বলল , আমি যাবাে , তবে আপনার সাথে নয় । আমি একা যেতে পারি । ‘ ‘ আমি আমার স্ত্রীকে একা ছাড়বাে না ।
আমার সাথে যেতে হবে । ‘ এই যে শুনুন , আপনি আমার উপর স্বামীর অধিকার ফলাতে যাবেন না । এসব আদিখ্যেতা আমার ভালাে লাগে না । ‘ আমি অধিকার ফলাতে আসিনি । আপনার পরিবার আপনাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন ।
আপনার ভালােমন্দ আমাকেই দেখতে হবে । এতাে জেদ ধরতে নেই । ‘ আমি জেদ ধরবাে নাকি চুপ করে থাকবাে সেসব বিষয়ে আপনার মাথা ঘামানাে লাগবে না ।
‘ নওরিনের টাস – টাস উত্তর শুনে মাহমুদ খুব কষ্ট পেল । মায়ের সাথে অপ্রতিকর আচরণ মাহমুদ এখনও ভুলতে পারেনি । মাহমুদ জামাকাপড় গােছানাে বাদ দিয়ে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে ।
রাগে – কষ্টে চোখ । লাল হয়ে গেছে । আকাশপানে উদাস দৃষ্টে তাকিয়ে ভাবছে , এটা কি আমার কোনাে পাপের শাস্তি , নাকি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনলাম ! কখনও কাউকে পাওয়ার আশায় দিওয়ানা হইনি । রবের উপর ছেড়ে দিয়েছলাম । তিনি যা করবেন তাতেই আমি খুশি ছিলাম ।
মাহমুদ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হাতে খাতা কলম নিয়ে একটি চিরকুট লিখে নওরিনের বালিশের পাশে রেখে নিচে শুয়ে পড়লাে.
রাত তিনটা বাজে । চারদিক নীরব , নিস্তব্ধ । সবাই দ্ৰিাপুরে । মাহমুদ তার বিছানায় উঠে বসলাে । অলসতা ঝেড়ে অযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল । হঠাত কান্নার আওয়াজে নওরিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
চোখ কচলাতে কচলাতে লাইট জ্বালিয়ে দেখলাে , রুমের কোণ ঘেঁষে জড়ােসড়াে হয়ে মাহমুদ মােনাজাতে কেঁদে কেঁদে কী যেন অভিযােগ করছে ।
নওরিন হতভম্ভ তাকিয়ে ভাবছে , আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়ে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে অভিযােগ করছে না তাে ?!
আমার কী দোষ !
আমি তাে তাকে কষ্ট দিতে চাইনি । আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিল কেন ! সব দোষ দাদার । এসব সাতপাঁচ ভেবে লাইট বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাে । চতুর্দিক আজানের সুরে মুখরিত । মুয়াজ্জিন সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলছে প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে । মাহমুদ নওরিনের পাশে গিয়ে নওরিনকে কয়েকবার ডাক দিল ।
কোনাে সাড়াশব্দ না পেয়ে মসজিদে চলে গেল । মাজেদা বেগম নওরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে উঠালেন । শান্ত গলায় বললেন , ‘ মাহমুদ ফজরের সময় তােমাকে ডেকে উঠাইনি ?
এখন তাে ফজরের ওয়াক্ত নেই । ‘ নওরিন চোখ কচলাতে কচলাতে বলল , জানি না । ‘ মাজেদা বেগম ভাবছেন , কাউকে কটু কথা বলে ভাল বানানাে যায় না ।
আদর সােহাগ দিয়েই আদর্শ বানানাে যায় । তিনি নওরিনের হাত ধরে বললেন , ‘ চলাে মা , নাশতা খেতে হবে । ‘ নওরিন চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতাে শাশুড়ির সাথে নাশতা খেতে বসেছে ।
এরই মধ্যে মাহমুদের স্কুল জীবনের বন্ধুরা এসে হাজির । মাজেদা বেগম পর্দার আড়াল থেকে তাদেরকে মেহমানখানায় বসতে বলে নাশতা তৈরি করতে লাগলেন । নওরিন কোনােরকম নাশতা খেয়ে মেহমানদের সাথে দেখা করতে চলে গেছে।
মাহমুদের এক বন্ধু বলে উঠলাে- “ নিশ্চয় আপনি আমাদের ভাবি ! নওরিন মুচকিহেসে উত্তর দিল- ‘ জি । আরেকজন বলল- ‘ মাহমুদ কই , ওকে তাে দেখছি না ।
ফোন করেছিলাম , ও বলল তােরা যা আমি এক্ষুণি আসছি ।
এখনও আসেনি ?
‘ না এখনও আসেনি । আরেকজন বলে উঠলাে- ভাবি , আপনি যে দেখতে খুব সুন্দরী সেটা কি আপনি জানেন ? ছেলেটার মুখে প্রশংসা শুনে আনন্দে গদগদ করে বলল- “ তাই নাকি !
“ হুম , শিওর । নওরিন লজ্জা পেয়ে চলে যেতেই দেখলাে মাহমুদ ওর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে । মাহমুদের রাগ মাথায় উঠে গেল ! মনে হচ্ছে নওরিনের গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেবে ।
কিন্তু না , সে রাগের ঢােকটি খুব কষ্টে গিলে নিয়ে শান্ত গলায় বলল , এখান থেকে যাও । ‘ নওরিন চুপচাপ চলে গেল । মাহমুদ সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাে ।
নাশতা সেরে সবাই গল্পে মেতে উঠলাে । হঠাত এক বন্ধু বলে উঠলাে , মাহমুদের বউ অনেক সুন্দরী । ভাই ! তুই তাে লাকি । এরকম একটা মাল কোথায় পেলি ? মাহমুদ বিরক্ত হয়ে বলল , “ মাল কী শব্দ ? একটা মেয়েকে এরকম । অপ্রিতিকর শব্দ ব্যবহার করে অপমান করা কোন ধরণের মানুষিকতা ?
সে আমার স্ত্রী । মেয়েদের সম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত । তারা মায়ের জাতি । তুই তাের মাকে এমন শব্দ বলতে পারবি ? তােরও তাে বােন আছে । তাের
চিরকুট
বােনকে যদি তাের সামনে কেউ এমন ভাষায় সম্বােধন করে তখন তুই ঠিক থাকবি ? ‘ আমার ভুল হয়ে গেছে । সত্যিই বুঝতে পারিনি । আসলে এমন ভাষা ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি ।
বন্ধুদের বিদায় দিয়ে মাহমুদ চুপচাপ ছাদে গিয়ে বসলাে । আকাশের দিকে নির্বাক তাকিয়ে নীরবে কাঁদছে । ছেলেরা খুব বেশি কষ্ট না পেলে সহজে কাঁদে না ।
মাহমুদ সবসময় একটি নােটবুক কাছে রাখে । নােটবুকের একটি পৃষ্ঠা ছিড়ে বড় করে একটি চিরকুট লিখে নওরিনের বালিশের পাশে রেখে চলে । গেল । আজ মাহমুদের মনটা ভীষণ খারাপ । কারাে সাথে তেমন কথা বলে না ।
সারাক্ষণ মনমরা করে বসে থাকে । আনমনে কী যেন ভাবে । মাজেদা বেগমছেলের নীরবতা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন । তিনি ছেলের কাছে গিয়ে বসলেন , মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন , “ তােমার কী হয়েছে বাবা ?
মন খারাপ করে বসে আছাে কেন ? মাহমুদ কান্না সংবরণ করতে পারল না । মায়ের কোলে মাথা রেখে হু হু । করে কেঁদে ফেলল । ছেলের কান্না দেখে মাজেদা বেগম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না । তিনিও কেঁদে ফেললেন । নওরিন চিরকুটগুলাে না পড়ে জাজিমের নিচে রেখে দিল ।
প্রতিদিন এসব আদিখ্যেতা তার ভাল লাগে না । মােবাইলটা বের করে বান্ধবী সােহাকে ফোন দিয়ে বলল , “ কতদিন হয় তােদের দেখি না । এখন আর জমিয়ে আড্ডা করতে পারি না । তােরা এসে আমাকে দেখে যা । ‘ সােহা তার আরও বান্ধবীদের সাথে নিয়ে আসবে বলে আশ্বাস দিল ।
নওরিন আনন্দে নাচতে নাচতে শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলল , ‘ আম্মা , আমার কয়েকজন বান্ধবী আসতে চাচ্ছে , তাদের নিয়ে আসবাে ?
মাজেদা বেগম বললেন , “ আসতে বলাে সমস্যা নেই । তাছাড়া তুমি তাে সারাক্ষণ মুখ গােমরা করে থাকো , বান্ধবীরা আসলে মনটা হালকা হবে ।
পরদিনই দলবেঁধে নওরিনের বান্ধবীরা বেড়াতে এসেছে । আজ ওর আনন্দ কে দেখে ! বান্দবীদের নিয়ে সােজা নিজেররুমে নিয়ে গেল । মাহমুদ মাদরাসা থেকে এসে রুমে ঢুকতে গিয়ে মেয়েদের দেখে আবার ফিরে আসলাে ।
আস্তে করে নওরিনকে ডেকে বলল , তাদেরকে অন্য রুমে বসতে দিতে । ওর ঘরে কাজ আছে । ‘ ‘ আরে এরা তাে আমার বান্ধবী ! আপনি আপনার কাজ করুন , কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না ।
‘ আমি ওখানে যাবাে না , আপনি তাদের অন্য রুমে বসতে দিন । ‘ এসব বুজুর্গি আর মােল্লাগিরি ছাড়ুন । এতাে সুফি আমার ভালাে লাগে ।
‘ নওরিনের বান্ধবীরা হাসাহাসি করতে লাগলাে । একজন বলে উঠলাে , আরে মােল্লারা সামাজিকতা বােঝে না । আরেকজন বলল , উপর দিয়ে সুফি সাজে , ভেতরে গিয়ে দেখ সব গােবর ভরা । মাহমুদ কথা না বাড়িয়ে মায়ের রুমে চলে গেল । নওরিন বান্ধবীদের সাথে গল্পে মেতে উঠেছে ।
এতদিনের জমানাে কথা সবাই উগড়ে দিয়ে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে । বান্ধবীদের মধ্যে সােহা নামের মেয়েটা বলল , “ এই নওরিন আমাদের ক্লাসের সীমার কথা শুনেছিস ? ” নওরিন বলল , “ কই না তাে ! কি হয়েছে ওর ?
চিরকুট
‘ ওর একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল । অনেক দিনের সম্পর্ক । দু’জন দুজনকে খুব ভালবাসতাে । সীমার বাবা – মা ওদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি । সীমার অন্য জায়গায় বিয়ের আলচোনা চলছিল । বিয়ের কথা ছেলেটাকে বললে ছেলেটা সীমাকে পালিয়ে বিয়ে করার কথা বলে ।
সীমাও রাজি হয়ে যায় । সীমা নিজের , মায়ের ও ভাবির সব গহনা চুরি করে সাথে নিয়ে নেয় । স্বর্ণকারের কাছ থেকে দুই ভােরি স্বর্ণের চেইন বাকিতে কিনে নেয় । আরও কয়েকজনের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা করজ নেয় । দিন – তারিখ ঠিক করে ওরা সুখের সংসার গড়তে রওয়ানা হয় । ঢাকায় একটা হােটেলে ওঠে ওরা ।
ছেলেটা ওর কয়েকজন বন্ধুকে ঠিক করে রেখেছিল ।
ওরা সবাই মিলে সীমার কাছ থেকে টাকাপয়সা , স্বর্ণ – গহনা সব হাতিয়ে নিয়েছে । পালাক্রমে ওর সম্ভ্রমহানি করে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় ফেলে চলে যায় । এক পথিক ওকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় । কিছুদিন চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়ে ওঠে সীমা । লােকটা সীমার বাবার নাম্বার নিয়ে ফোন করে । মেয়ের খবর পেয়ে তারা
ছুটে যায় ঢাকা । মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসে ।
এখন গ্রামের সবাই তাকে ছিঃ ছিঃ করছে । নওরিন সীমার এই অবস্থার কথা শুনে ব্যাথিত হয়ে বলল , “ ইশ ! মেয়েটা । এরকম কেন করলাে ! ‘ এদিকে মাহমুদ রাগ করে জামা – কাপড় গুছিয়ে একটি চিরকুট লিখে টেবিলের পর রেখে দেয় ।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চল্লিশ দিনের জন্য তাবলীগের সফরে চলে যায় ।
বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে একা হয়ে যায় নওরিন । কিছু ভালাে লাগছে না ওর । অনেক রাত হয়ে গেছে , অথচ মাহমুদের আসার নাম নেই । ভয়ও
আসেনি এখনও ? পাচ্ছে । নওরিন শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলল , “ মা ! আপনার ছেলে বাসায় মাজেদা বেগম বললেন , মাহমুদ তাে চল্লিশ দিনের জন্য তাবলীগের সফরে চলে গেছে ।
তােমাকে কিছু বলেনি ? ‘ কই না তাে ! ‘ ‘ ওর কিছু ভালাে লাগছিল না , তাই বাসা থেকে চলে গেছে । তবে সময়টা যেন কাজে লাগে এজন্য এদিক – ওদিক না গিয়ে তাবলীগেই চলে গেল ।
আজ প্রথমবার নওরিন মাহমুদের প্রতি কেমন যেন টান অনুভব করছে । ঘর জুড়ে যেন হাহাকার পড়ে গেছে । কোনােকিছুতে শান্তি পাচ্ছে না সে । আনমনে বসেবসে ভাবছে- মানুষটা হয়তাে আমার উপর রাগ করে চলে গেছে । আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি তাকে ।
আচ্ছা , আমি তাে তাকে ভালবাসি , কিন্তু তার জন্য এতাে কষ্ট হচ্ছে কেন আমার ? তার অভাব জেঁকে ধরেছে । কেন আমায় ? তাহলে আমি কি তাকে ভালবেসে ফেলেছি ? সে হুজুর হলেও তার চেহারায় অদ্ভুত একটা মায়া আছে ।
আমি বরং ঘরের কাজে লেগে থাকি তাহলে তার কথা মনে পড়বে না । • এই ভেবে টেবিল গােছাতে গিয়ে দেখে একটি কাগজে কী যেন লেখা । হাতে নিয়ে দেখে মাহমুদের হাতের লেখা । চিরকুটটা দেখে আগের চিরকুকগুলাের কথা মনে পড়ে গেল ।
জাজিমের নিচ থেকে সবগুলাে চিরকুট বের করে আসন গেড়ে বসে পড়া শুরু করলাে নওরিন চিরকুটটি বুকে জড়িয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল , অনেক ভুল করে ফেলেছি আমি । মানুষটি এতােটা ভালাে ! আমি কত কষ্ট দিই তবুও সবসময় ভালাে ব্যাবহার করেছে । জমে থাকা অশ্রু মুছে আরও একটি চিরকুট খুলে পড়তে লাগলাে
“ আমার স্ত্রী বাজারের পণ্য নয় । সে আমার কাছে স্বর্ণের চেয়েও দামি । আমি চাই না আমার কোনাে বন্ধু তাকে দেখে কোনাে বাজে মন্তব্য করুক । আমার স্ত্রীকে কেউ লােলুপ দৃষ্টিতে দেখুক সেটা আমি চাই না । জানাে , সেদিন যখন আমার বন্ধুরা তােমাকে দেখে নানান মন্তব্য করেছিল , তখন আমার নিজেকে অনেক ছােট মনে হয়েছিল ।
ইসলাম নারীকে সম্মান দিয়েছে। নারী গােপন জিনিস , তাকে স্বযত্নে আগলে রাখতে হয়. পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় । ” নওরিনের মনে পড়লাে সীমার কথা ।
সীমা ভুল পথে যাওয়ার কারণে আজ তার কী করুণ দশা ! সে যদি নিজেকে সংবরণ করতাে তাহলে সে আজ সমাজের চোখে এতাে খারাপ হতাে না । আসলেই ইসলাম শান্তির ধর্ম । ইসলাম শান্তির বাণী শেখায় । এরপর আরও একটা চিরকুট খুলল “ জানাে নওরিন , কখনও কোনাে মেয়েকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখিনি । সবসময় চেয়েছি , আল্লাহ আমার তাকদিরে যাকে রেখেছেন সে – ই হবে আমার হৃদয় রাজ্যের রানি । আর আমি হব তার রাজা ।
বাইরের সব মেয়ের থেকে আমার চোখে তুমি সবচেয়ে বেশি সুন্দর । অন্য কোনাে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমি চোখের জিনা করতে চাই না । অন্যসব মেয়ে আমার চোখে বােনের মতাে ।
আমি শুধু তােমাকে নিয়েই সুখে থাকতে চাই । কিন্তু তুমি আমার মনটা বুঝলে না , বুঝার চেষ্টা ও করলে না । আমি হুজুর বলেই তােমার সমস্যা । আমি নবীর সুন্নাত পালন করে দাড়ি রেখেছি বলেই তুমি আমায় অপছন্দ করাে ।
আমার কিছু বলার নেই , আমি তােমার চাহিদার পূরণে অক্ষম । যদি আমার সাথে থাকতে ভালাে না লাগে , তাহলে তােমার পরিবারকে জানাবে । আমি কাউকে জোর করে বেঁধে রাখতে চাই না ।
ভালােবাসা জোর করে আদায় করা যায় না । কারাে জীবনে কাঁটা হয়ে থাকতে চাই না । আমি তােমার থেকে বহুদূরে চলে যাচ্ছি । জানি না ফিরে আসতে পারব কি না । যদি আমার কথায় কিংবা কাজে কষ্ট পেয়ে থাকো , দয়া করে ক্ষমা করে দিও । ইতি- মাহমুদ । ”
চিরকুট নওরিন এত শক্ত থেকেও কখন যে তার হুজুরকে ভালােবেসে ফেলেছে । | নিজেও জানে না । মেয়েটি অজান্তে বলে ফেলল , ভালােবাসি মাহমুদ । এই বলে চিরকুটগুলাে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল , আমি আর ভুল করব না , দয়া করে আপনি ফিরে আসুন । মাজেদা বেগম নওরিনের রুমে এসে দেখেন সে মুনাজাত ধরে কাঁদছে ।
আর মাহমুদের ফিরে আসার দোয়া করছে । মাজেদা বেগম পুত্রবধূর কান্না দেখে তার পাশে গিয়ে বসলেন । নওরিন । মােনাজাত শেষ করে শাশুড়িকে ধরে বলল , ‘ মা ! আমি অনেকভুল করেছি , আমায় ক্ষমা করে দেন । মাজেদা বেগম নওরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল , ‘ পাগলী মেয়ে , মা কি কখনও সন্তানের উপর অভিমান করে থাকে ? ‘ মা , আমি আজ থেকে আপনার মেয়ে হতে চাই । ‘
‘ তুমি তাে আমারই মেয়ে । ‘
আপনার ছেলে আমায় ক্ষমা করবে তাে ?
‘ অবশ্যই করবে । মাহমুদ তাে চায় তুমি তােমার ভুল বুঝে ফিরে আসাে ।
‘ মাহমুদের বিয়ােগ ব্যথায় নওরিন অস্থির হয়ে পড়ে । একেকটা দিন ওর কাছে মাসের মতাে মনে হয় । ঠিক চল্লিশ দিন পর মাহমুদ বাড়ি আসে ।
এই দিনটির জন্য নওরিন এতদিন ধরে ধরে অপেক্ষা করছে । মাহমুদ বাড়ি এসে দেখলাে , বাড়ির পরিবেশ আজ অন্যরকম । যেন জান্নাতি পরিবেশ । মায়ের সাথে দেখা করে এরপর নওরিনের কাছে গিয়ে দেখে , সে নামাজ পড়ছে । মাহমুদ নওরিনের নামাজ পড়া দেখে অস্ফুটে বলে । উঠলাে- আলহামদুলিল্লাহ ! নওরিন নামাজ শেষ করে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলে , ‘ আজ বুঝি আসার সময় হলাে ! ‘
মাহমুদ মুচকিহেসে বলল , “ আজই তাে আসার কথা ছিল নওরিন মাহমুদের হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিল । মাহমুদ চিরকুট খুলে দেখলাে বড় অক্ষরে লেখা “ আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি ।
” মাহমুদ আলতাে করে নওরিনের চোখ ধরে বলল , “ চোখ খুলবে না ।
‘ যদি খুলি ? ‘ মাইর হবে ।
‘ আচ্ছা খুলব না । ‘ এরপর মাহমুদ নওরিনের হাতে একটি গােলাপ আর একটি হিজাব দিয়ে মুচকি হেসে বলল , ‘ সারাজীবন একটি হিজাবী বউয়ের স্বপ্ন পুষেছিলাম । ‘