অপেক্ষা
মোর্শেদা হোসেন রুবি
সামনেই পরীক্ষা।তাই খুব জোরেশোরে ক্লাসগুলোতে পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে।আজো ছোট দুটো টেষ্ট নিলেন ইকবাল স্যার।ক্লাসে উপস্থিত ছিলো ওরা একশ বিশ জন।তাদের মধ্যে সবচে হাইয়েষ্ট নম্বর এসেছে জাহিদের।বন্ধুরা জানতো এবারো জাহিদই ফার্ষ্ট হবে।এ পর্যন্ত জাহিদ কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়নি।ওর পুরোনো বন্ধুরা জানে জাহিদ অসম্ভব মেধাবী একটা ছেলে।
স্কুল লাইফেই বৃত্তি পেয়েছে দুবার,কলেজেও তেমনি!এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করছে।
জাহিদের সবচে কাছের বন্ধু….থুরি বান্ধবী মেঘাও আইনের ছাত্রী।দুজনের কলেজ লাইফ থেকে বন্ধুত্ব।সেটা প্রেমে পরিণত হতে বেশিদিন লাগেনি।দুজনের প্রেম আর কিছুদিনের মধ্যেই পরিণয়ে রূপ নেবে এমনটিই সবার ধারনা।
মেঘা এরই মধ্যে বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল জাহিদকে।মেঘার বাবাও খুশি হলেন জাহিদকে দেখে,যেমন মেধাবী তেমনি গুডলুকিং।মেয়ের পছন্দকে এপ্রিসিয়েট করলেন তিনি।
ঠিক হলো পরীক্ষা শেষ হলে ওদের বিয়ে দিতে তার কোনো অমত নেই।
তাছাড়া জাহিদের বাবার সাথেও দেখা করতে হবে।মেঘা তাই সুযোগ পেলেই জাহিদকে তাগাদা দেয়,”বাসায় জানিয়েছো?কবে বলবে আমাদের কথা ?”
জাহিদ সান্তনা দেয়-“আরে বাবা,পরীক্ষাটা তো যেতে দাও!এতো অস্থির হচ্ছো কেন?”
-“অস্থির কি সাধে হই?ছেলেদের মতিগতির কোনো ঠিক আছে?”
-“এখনো বিশ্বাস করোনা আমাকে?”
-“,করি তো..!”
মেঘা হাসে কিন্তু সান্তনা পায়না কারন জাহিদ এখনো ওর বাসায় এ ব্যপারে কিছুই জানায়নি।জাহিদের পরিবার গ্রামে থাকে,
জাহিদের বাবা গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন গৃহস্থ।গ্রামের সম্মাণিত মানুষ।জাহিদের মুখেই শুনেছে তিনি খুবই কড়া ধরনের মানুষ এবং বেশ রাগী।
জাহিদ ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসতেই মেঘার সাথে দেখা হলো।মেঘা বলল-“চলো তোমাকে চা খাওয়াবো!”
জাহিদ মাথা নাড়ল-“না,চা খাবোনা,হলে চলে যাবো,বাসায় যোগাযোগ করতে হবে!”
-“বাসায় কিছু হয়েছে?”জাহিদের মুখটা আজ একটু মলিনই মনে হলো মেঘার কাছে,তাই প্রশ্নটা করল।জাহিদ দীর্ঘশ্ব্স ফেলে বলল-“আম্মার শরীরটা নাকি বেশী খারাপ।এদিকে সামনে পরীক্ষা,কি যে অবস্থা?”
-“বাসায় জানিয়েছো পরীক্ষার কথা?”
-“হ্যা,আব্বা তো জানেই,আম্মাও জানে!আব্বা পরীক্ষা দিয়েই দেশে যেতে বলেছে।”
মেঘার মুখটা এবার মলিন হলো-“কবে ফিরবে?”
-“এক সপ্তাহের বেশীতো কোনোদিনই থাকিনা,জানোইতো!তাছাড়া এবার স্কলারশিপ পেলে দেশের বাইরে যাবো ‘বার এট ল”টা’ করতে সেটা নিয়েও আলাপ করতে হবে!”
-“আমি আব্বুকে বলেই রেখেছি,তোমার সাথে যাবো,আব্বু বলেছেন বিয়ে করে তারপর যেতে,এভাবে যেতে দিতে উনি রাজী নন!”মেঘা জানালো!
-“হমম…দেখি,বাড়ী থেকে আগে ফিরি তারপর এসব নিয়ে ভাববো!”
পরীক্ষা শেষ হতে হতেও দুটো মাস চলে গেল।এর মধ্য মায়ের সাথে ফোনে দুবার কথা বলেছে জাহিদ।উনি আগের চেয়ে ভালো আছেন।তবে জাহিদকে খুব করে দেশে যাবার জন্য অনুরোধ করেছেন!
পরীক্ষা শেষ হবার পরদিনই দেশ থেকে বাবার ফোন এলো।মা খুব বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েছে,তাই বাবার কড়া আদেশ জাহিদ যেন রাতের ট্রেনেই রওনা দেয়।
বাবার আদেশ উপেক্ষা করার শক্তি জাহিদের কোনোদিনই ছিলোনা,আজো নেই।মেঘার সাথে দেখা করার সুযোগ হলোনা ওর,তাই মেঘাকে ফোন করে দেশে যাবার কথাটা জানিয়ে দিলো জাহিদ।শিঘ্রই ফিরবে,এমন আশ্বাস দিতেও ভুললোনা!
রাতের ট্রেনেই জাহিদ সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
কোনোরকমে নাস্তাটা সেরেই ফারুক শার্টটা গায়ে চড়ালো!বাম হাতে ঘড়িটা পড়ে টুপিটা মাথায় দিয়ে দুহাতে কোনরকমে দাঁড়ীগুলোতে আঙ্গুল চালালো পরিপাটি করার উদ্দেশ্যে।তারপর দ্রুত পা চালালো!
শান্তদের বাসা এখান থেকে পাঁচ মিনিটের পথ।তবু আজ দেরী হয়ে গেছে বলে ফারুককে দ্রুত পা চালাতে হচ্ছে।ছেলেটার পরীক্ষা চলছে অথচ পড়ায় একদম মন নেই।
ফারুক গিয়ে ধরে বসলে ততক্ষণই পড়ে।ফারুক চলে গেলে সে নাকি সারাদিন আর পড়তে বসেনা!শান্ত ক্লাস ফোরে পড়ে।পড়ালেখায় যথেষ্ট মেধাবী হলেও সে চুড়ান্ত ফাঁকিবাজ।তবে ফারুককে যথেষ্ট সমীহ করে!
শান্তদের পরিবারের উপরও ফারুকের রাগ লাগে।ছেলের পরীক্ষার মাঝখানে মেয়ের বিয়ের এনগেজমেন্ট করল সেদিন।শান্ত প্রচুর নাস্তা ফারুকের সামনে দিয়ে দাঁত বের করে বলেছিলো-“স্যার,আপার আজ পানচিনি,তাই আজ পড়বোনা!”
-“পানচিনি আবার কি?”ফারুক প্রশ্ন করেছিলো!
-“এনগেজমেন্ট বুঝেন?আমার আপাকে আজকে আংটি পড়াবে ছেলেপক্ষ ! ”
-“তারমানে বিয়ে?’
-“না..না..শুধু আংটি..বিয়ে ছমাস পর!”
ফারুক আর কোনো কথা বললো না!এসব আধুনিক যুগের নানান ভিত্তিহীন রেওয়াজ রুসুমের প্রতি তার বিস্দুমাত্র আস্থা নেই!
একটা আংটির বৃত্তে দুটি ছেলেমেয়েকে বেঁধে ফেলা তারপর প্রেম করতে ছেড়ে দেয়া।এ যেন অভিভাবকের অনুমতি নিয়েই জেনা করা!
শান্তদের বাড়ীর সামনে এসে বেল বাজালো ফারুক।দরোজা খুলল একটি মেয়ে,শান্ত ভদ্র মুখশ্রী।ফারুক চট করে চোখ নামিয়ে ফেলল।হাতের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল-“শান্ত আছে? আমি ওর টিচার!”
-“জ্বী, আছে,আপনি বসুন আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি!”
ফারুক ড্রইংরুমে বসল।কিছুক্ষণ পরই শান্ত এলো ক্রিকেট ড্রেস পরিহিতাবস্থায়।
-“স্লামালিকুম স্যার…!”
ফারুক ওর দিকে তাকিয়ে বলল-“আবার স্লামালিকুম? এভাবে সালাম শিখিয়েছি তোমাকে?সালামালিকুম মানে কি?”
-“,স্যরি..স্যার..আসসালামু আলাইকুম!”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম!তা পরীক্ষার মাঝখানে এসব কি?ব্যাটবল কেন হাতে?”
-“ঐ একটু…!”
-“যাও রাখো..!”ছোটখাটো হুঙ্কার দিল ফারুক।শান্ত দ্রুত হেলমেট প্যাড খুলতে লাগল!তারপর শান্ত ছেলের মতই পড়তে বসে গেল!
ট্রেন থেকে নেমে জাহিদদের বাসা পায়ে হাঁটা পথ।তবু জাহিদ রিক্সা নিলো কারন ওর হাতে বেশ কিছু লাগেজ রয়েছে।রিক্সা একেবারে বাড়ীর সামনে গিয়ে থামল।
সিলেট শহরের উপকন্ঠেই জাহিদদের সুন্দর দোতলা পাকাবাড়ী।
জাহিদ ভেতরে ঢুকে প্রথমেই মনে মনে ধাক্কা খেলো মা’কে রান্নাঘরে বসে রান্নার বিশাল আয়োজন নিয়ে বসে থাকতে দেখে।কারন সে মায়ের খুব অসুখ শুনেই দৌড়ে এসেছে।
মা ওকে দেখে খুশিতে উঠে এলো-“এসেছিস বাবা আমার!”বলে জাহিদকে জড়িয়ে ধরলেন।চোখে পানি!
-“হ্যাঁ..কিন্তু তুমি অসুস্থ মানুষ রান্নাঘরে কি করছো?”
-“দুর, তোর বাবার কথা..ভালো মানুষকে রুগী বানিয়ে দেয়!চল্,ঘরে চল।তোর পছন্দের সব কিছু করেছি রাত জেগে জেগে!”
-“এভাবে আমাকে ভয় দেখিয়ে আনানোর মানে কি?আব্বা কই?”
-“তোর আব্বা কুমকুমদের বাসায় গেছে!এসে পড়বে!তুই হাত মুখ ধো…তোর জন্য চালের আটার গরম গরম রুটি আর হাঁসের মাংস রেধেছি!তুই পছন্দ করিস!নাস্তা খেয়ে ঘুম দে!সারারাত জার্নি করেছিস!”
জাহিদ কথা না বাড়িয়ে হাত মুখ ধুতে গেল।
জোর করে পেটপুরে খাওয়ালো মা!ভরপেট খাওয়ার কারনেই কিনা কে জানে জাহিদের খুব ঘুম পাচ্ছে।সে ঘুমিয়ে পড়ল।মা ওর ঘরটা আগে থেকেই সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিলো!জাহিদের ঘুম ভাঙ্গলো একেবারে বেলা পার করে।
আব্বার কড়া খাকারীতে জাহিদের ঘুম দুর হয়ে গেল।আব্বা ওর বিছানায় এসে বসেছেন।জাহিদ দ্রুত ইঠে বসল-“আসসালামুআলাইকুম,আব্বা!”
-“ওয়া..লাই..কু..মু..স্সালাম।”টেনে টেনে সালামের উত্তর দিলেন আব্বা।তারপর বললেন-“ঘুমিয়ে যে দুপুর পার করে দিলি জোহরের নামাজ তো কাযা হতে চলল!নামাজ মনে হয় ঠিকমতো পড়িসনা তাইনা?”
জাহিদ আমতা আমতা করতে লাগল-“,না মানে…ইয়ে..পড়ি..তো..!”
-“যাও,গোসল সেরে নামাজ পড়ে ভাত খাও..তোমার সাথে জরুরী কথা আছে!”
জাহিদ মনে মনে চমকালো কিছুটা। আব্বা ওকে তুমি তুমি করে কথাটা বললেন!ব্যপার কি!কিন্তু আব্বাকে সে খুব ছোটবেলা থোকেই যমের মত ভয় পায় ভয়টা এই বয়সেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি!”
ফারুক বেল বাজাতেই শান্ত’র বোন দরোজা খুলে দিলে ফারুক প্রতিবারের মতোই টোখ নামিয়ে মোবাইলে নিবদ্ধ করল,এবার আর শান্তকে ডেকে দিতে বলল না।শান্তর বোনই নিজে থেকে বলল-“আসুন”!
ফারুক পড়ার টেবিলে বসে আছে,শান্ত লিখছে।হঠাৎ ভেতর থেকে শান্ত’র বোনের গলা শোনা গেল-“আমি যাবোনা মা!”
অপর গলাটা সম্ভবত শান্তর মা’য়ের।তিনি বলছেন-“নতুন আত্মীয়,তার উপর তোর শ্বাশুড়ী নিজে ফোন করে আমাকে বলেছে তোকে পাঠিয়ে দিতে!”
-“কিন্তু অনুস্ঠানের আগে আমি ওর সাথে কেন যাবো?”
-“কি হয়েছে..সে তো তোর স্বামীই হবে!”
-“হবে..হয়নি তো এখনো!”
-“না গেলে জিসান রাগ করবে!”
-“কেন? আমি কি তাদের বাড়ীর বউ যে রাগ করবে?”
-“বউ তো হবিই,তো রাগ করবেনা?”
-“উফ্…তোমাকে বোঝাতে পারছিনা কেন?”
ফারুক গালে হাত দিয়ে শান্তর অংক করা দেখছে।না চাইতেই ভেতরকার শব্দগুলো ফারুকের কানে চলে আসছে।
অংক শেষ হলে ফারুক শান্তকে বলল-“ভেতরে গিয়ে আম্মুকে বলো,আস্তে কথা বলতে!বলো সব বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে..!আমি যে বলতে বলেছি এটা বোলোনা”! বলে ফারুক কপাল কুঁচকে খাতাটা টেনে নিলো!
জাহিদ আব্বার ঘরে বসে আছে!আব্বা এশার নামাজ পড়ে ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছেন।জাহিদ তার প্রবল ব্যাক্তিত্বের সামনে নিজেকে বড় অসহায় বোধ করে।আব্বা বললেন-“,তোর মা’তোকে কিছু বলেনি?”
-“কি ব্যাপারে আব্বা?”
-“তোকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবো!মেয়ে তো আমাদের জানাশোনা!কুমকুমের কথা মনে আছে?আরে তুইই তো ওকে মক্তবে থাকতে বাংলা ইংরেজী পড়াতি!”
জাহিদ একটা পালস বিট মিস করল,মেয়ে তার জন্য?হতভম্ব হয়ে বলল-“মেয়ে দেখতে যাবেন,কার জন্য আব্বা?”
-“এ বাড়ীতে পুরুষ বলতে তুই আর আমি!তোর কি মনে হয় আমি আমার কথা বলছি? বেকুবের মত প্রশ্ন করিস কেন?তোর পরীক্ষা শেষ হবার অপেক্ষা করছিলাম।পরীক্ষা তো শেষ!”
-“ক্..কিন্তু….আমার বিয়ে আমার পছন্দ হতে হবেনা?এভাবে হুট করে…!”
-“তোর পছন্দের কথা মাথায় রেখেই তোকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাওয়া নইলে একবারে বিয়ে পড়িয়ে দিতাম!”
জাহিদ চুপ করে বসে আছে।কিভাবে কি বলবে মাথায় আসছেনা।আব্বা পুরো তৈরী হয়ে বলছেন,তোর বিয়ে…মেয়ে দেখতে যাবো!কোনো মানে হয়?মেঘার কথাটা কিভাবে বলবে সে?
আম্মাকে বলতে পারতো কিন্তু আব্বার সামনে তো পারবেই না!
এমন সময় আব্বা কথা বলে উঠলেন-“তোর লেখাপড়ার পিছনে কম ঢালিনি,তোকে মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে চাইলাম কিন্তু বললি যে না,শহরে কলেজে পড়বো..দিলাম পাঠিয়ে শহরে!কলেজ ভারসিটি শেষ করেছিস,
তো এখন বিয়ে না করলে কবে করবি?বুড়ো বয়সে?”
-“কিন্তু আব্বা..বার এট ল করতে চাই আমি,নইলে এত কষ্টের কোনো দাম থাকবেনা!বটতলার উকিল হয়ে বসে থাকতে হবে!”
-“তোকে ব্যারিষ্টারী পড়াতে প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকা লাগবে।তা নাহয় দিলাম কিন্তু আজকের দুনিয়াদারীর উপরে আমার বিশ্বাস নাই।শহরের মেয়েগুলা টোপ নিয়ে ঘুরে,
মোটাতাজা মাছ দেখলেই বরশিতে গেঁথে ফেলবে তাই তোকে বিয়েটা করিয়ে দেই তুইও শান্তিমতো পড়তে যা! ”
-“কিন্তু আব্বা..!”
-“আবার কিন্তু কি?যা তৈরী হ্!কুমকুমকে দেখতে নিয়ে যাবো তোকে।যদিও দেখাদেখির কিছু নাই।খুবই ভদ্র,নামাজী আদবদার মেয়ে।মাদ্রাসা শেষ করেছে এ বছর।সেখানেই শিক্ষকতা করছে।এ যুগে এমন চৌকস মেয়ে হারিকেন দিয়ে খুঁজে পাবিনা!
বিয়েটা করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব।তারপর আমি মরে গেলে দোয়া দিবি আর বলবি কি সম্পদ তোকে দিয়ে গেলাম।শোন্..দিনকাল একদম ভালো না।মানুষের মধ্যে এখন ভেজাল ঢুকে গেছে!যা বলি তোর ভালর জন্যই বলি!যা ওঠ্,কথা বাড়াসনা!”
জাহিদ হিপনোটাইজড মানুষের মত উঠে শার্ট পড়ল।তারপর আব্বা আর আম্মার সাথে কুমকুম নামের মেয়েটির বাড়ীতে গেল।
কুমকুমের মা সামনে আসলেন না,কুমকুমের বাবা এসে হাত মেলালেন।তারপর নাস্তা পর্ব শেষে জাহিদকে একটা রুমে বসিয়ে জাহিদের আম্মাই কুমকুমকে নিয়ে আসলেন।বোরকার মত কি যেন একটা পড়েছে,
কেবল মুখটা খোলা।সে যে কুমকুমকে চিনতো তার সাথে এই কুমকুমের কোন মিলই নেই।ছটফটে কিশোরীটি কেমন চুপচাপ শান্ত হয়ে গেছে।
আপাদমস্তক ঢাকা কুমকুম নামের মেয়েটি কেবল সালাম দিল,জাহিদও কোনো কথা বললো না,কুমকুম তো নয়ই।সে মুখ নত করে বসেছিল।মিনিট পাঁচেক পর জাহিদের আম্মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে কুমকুমকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন!
বাবা সেখানেই বাজখাই গলায় ঘোষণা দিলেন যে আগামী কাল সন্ধ্যায়ই বিয়ে হবে।যেহেতু ছেলে বার এট ল’পড়তে দেশের বাইরে চলে যাবে তাই আর দেরী করবেন না তিনি!বউ আর কি সে তো নিজের মেয়ের মতই…এ বাড়ী থাকতো এখন ও বাড়ী যাবে!
কাল একেবার বিয়ে পপড়িয়ে ববউ ননিয়ে যাবেন তিনি।বলে হা হা করে হেসে কুমকুমের বাবার সাথে কোলাকুলি করে পাকা কথা দিয়ে বিদায় নিয়ে আসলেন।
রাতে মা’কে একা পেয়ে জাহিদ ফিসফিসিয়ে জানালো মেঘার কথা।মা দ্রুত আঁচল মুখে তুলে বললেন-“ইন্নালিল্লাহ!তোকে ওখানে পড়তে পাঠিয়েছি না মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে?
তুই কোন্ বাড়ীর ছেলে একথা ভুলে যাস না!তোর বাবা শুনলে আগুন লাগিয়ে দেবে।ওসব বাদ দে বাবা!আমি তো তোর বাপকে একথা বলতেই পারবোনা!
সারাটা দিনই জাহিদের চরম উৎকন্ঠার মধ্যে কেটেছে!মোবাইলটা কতবার যে হাতে নিলো আর রাখলো তার ইয়ত্তা নেই।মেঘাকে কি বলবে সে?
ও তো শুনলে কেঁদেকেটে একাকার করবে!নতুবা ট্রেন ধরে সোজা চলে আসবে এখানে!নাহ্..মাথা কাজ করছেনা!
মত অমত দ্বিমতের দোলাচলে কুমকুমের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো জাহিদের।মা পারকপক্ষে জাহিদের সামরে এলেন না!একেবারে সন্ধ্যেবেলায় মাথায় হাত রেখে কেবল বললেন-“কুমকুম ভারী মিষ্টি মেয়ে।ওকে বিয়ে করে তুই অসুখী হবিনা বাবা।”
-“কি সে আমার সুখ তা যদি তোমরা বুঝতে তাহলে এভাবে বলতে না!’
-“শোন্ রে বাবা….রূপে মন ভুলায় কিন্তু বিবাহিত জীবনে রূপের পাশে গুনটাও লাগে!কুমকুম গুনী মেয়ে!”
-“গেঁয়োভুত একটা মেয়ের গুন কি হতে পারে তা আমার জানা আছে।কাঁথা সেলাই করা আর পিঠা বানানো ছাড়া এরা পারে কি?”
-“তোর মা’ও কিন্তু আরেক গেঁয়োভুত।বুঝে কথা বলিস!শোন্,ভবিষ্যত বংশধর কেমন চাস তা পুরুষকে বিয়ের আগেই ঠিক করতে হবে।কারন যেমন মা কেমন ছা হয়।চোখের ভাললাগায় কেউ জীবন বাজী রাখে?
মনে রাখিস…সোনার খনিতে সোনাই জন্মায় আর কয়লার খনিতে কয়লা!কুমকুম যে সোনার মেয়ে তা তোকে হলফ করে বলতে পারি,একদিন টের পাবি,এই বলে রাখলাম!”
আর কথা হলোনা।বিয়ে পড়ানোর পর মেয়েদের বাড়ীতে চাপা কান্নার রোল।জাহিদ বিরসমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে!বউ নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল।
জাহিদ নিজের ঘরে ঢুকে কিছুটা অবাক হলো।তার ঘরটা সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।খাটে চুপ করে কুমকুম বসে আছে।জাহিদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এটা তার বাসর।সে তো মেঘাকে নিয়ে….
ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে জাহিদের চিন্তা বাধা প্রাপ্ত হলো!খানিক ইতস্তত করে খাটের পাশে যেয়ে দাঁড়াল।
মেয়েটা চোখ মুছে ধীরে ধীরে খাট থেকে নামলো!তারপর মৃদু স্বরে বলল-“একটু বসবেন,প্লিজ?”
‘প্লিজ’ শব্দটা শুনে মনে মনে একটু চমকে গেল জাহিদ।কিছু না বলে বসল!কুমকুম তার পা ছুঁয়ে সালাম করলো তারপর একটা কাগজ জাহিদের হাতে দিয়ে বলল-“আমার কপালে হাত রেখে এটা পড়তে হবে আপনাকে!”বলছে আর চোখ মুছছে!
কুমকুম কাঁদছে বলেই কিনা চোখটা আর গালটা লালচে হয়ে আছে।এখনো ফোঁপাচ্ছে আবার এটা ওটা করতেও বলছে।অদ্ভুত মেয়ে তো।চুপচাপ একজায়গায় বসে কানতে থাক্….তোর এতো কথা বলার দরকার কি!..
জাহিদের একদম কথা বলতে ইচ্ছে করছে না!”
জাহিদ কাগজটা খুলে এই প্রথম মুখ খুলল-“এটা কি?”
-“এটা দু’আ!স্ত্রীর কপালে হাত রেখে স্বামীকে পড়তে হয়।তবে তার আগে নামাজ পড়তে হবে!অযু আছে আপনার?”
-“,মম…হ্যাঁ…আছে মনে হয়!কেন?!”
-“মনে হয় টয় না,আসুন,অযু করবেন!”শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলল কুমকুম।
-“আবার অযু করবো?”জাহিদ বিরক্ত হলো!
-“জ্বী,করতেই হবে!অযুটা ভাঙলেন কেন?!”
জাহিদ অবাক হলো কিছুটা।মেয়েটাতো চমৎকার কথার পিঠে কথা চালাতে পারে! তাকে যতটা গেঁয়ো ভেবেছিলো ততটা সে না!”
-“কই আসেন!”
জাহিদ মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেল।কুমকুম মগ ভরে পানি তিরতির করে ঢাললো আর জাহিদ অযু করলো।দুবার কুমকুম বাধা দিলো,আহ্..এভাবে কুলি করেন কেন গড়গড়া করেন..!”
-“উহ্,বাসর রাত থেকেই মাস্টারী?’মনে মনে বলল জাহিদ।অযু শেষে টাওয়েল এগিয়ে দিল। তারপর নিজে গিয়ে দুটো জায়নামাজ বিছালো!একটা একটু সামনে অপরটা পেছনে!
-“আপনি কিন্তু নামাজ পড়াবেন!”
-“আমিই?”
-“হ্যাঁ..কেন,কোনো সমস্যা?ইমামতি তো ছেলেদেরকেই করতে হয়।ইমাম মানে নেতা।একটা সংসারের নেতৃত্ব আপনাকে দেয়া হলো।প্রতিটা পুরুষকেই দেয়া হয়।কে কেমন সংসারে নেতৃত্ব দিতে পারে সেটার উপরই সেই সংসারের ভবিষ্যত নির্ভর করে!”
-“তুমি তো মনে হয় মাদ্রাসায় মাস্টারী করো তাই না?”
-“জ্বী,কেন?”
-“লেকচার শুনে মনে পড়ল।”
কুমকুমের মুখটা হঠাৎই লজ্জায় লালচে হয়ে গেল-“দুঃখিত!চলুন নামাজ পড়ি!”
শান্তদের বাড়ী থেকে বেরোবার মুখে গাড়ীটা দেখল ফারুক।সানগ্লাস পড়া একটা ছেলে বসে আছে ভেতরে।একটু পর শান্তর বোনকে নামতে দেখা গেল।
ফারুক নিজের মত করে হেঁটে চলে এলো!
আজ তার ভার্সিটিতে ইমপর্টেন্ট ক্লাস আছে।তাছাড়া বাড়ীতে আজ তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলা হয়েছে,তাকে নিয়ে কোথায় যেন মেয়ে দেখতে যাবার কথা!ফারুক পা চালাল।
মুমু গাড়ীতে ওঠার পর থেকে চুপ করে বসে আছে।একটা কথাও বলেনি! জিসান কয়েকবার এটা ওটা জিজ্ঞেস করেছে।মুমু দায়সারা গোছের উত্তর দিয়েছে!কেন জানি মুমু জিসানের সাথে সহজ হতে পারেনা।
আজ মুমুকে নিয়ে জিসানের বড়বোনের বাড়ীতে যাবার কথা!ওর বড় বোনের ম্যারেজডে আজকে।
মুমু সবসময়ই ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে।হৈ হুল্লোড় চেঁচামেচি হুড়োহুড়ি ওর ভালো লাগেনা,ও নিরিবিলি থাকতে ভালবাসে!বাবা নেই মুমুর।মা আর শান্তকে নিয়েই ওর জীবন আবর্তিত।
মুমুর বড়খালা খুব ধনী মহিলা।তিনিই মুমুর জন্য এই বিয়ের প্রস্তাবটা এনেছেন।তার ধারনা মুমুদের পরিবারের লাখ শোকর করা উচিত,
এমন ধনী ছেলে পেয়ে,ছেলের ঢাকায় গাড়ী বাড়ী সব আছে।সে যে মুমুকে দেখে পছন্দ করেছে এটাই মুমুর সৌভাগ্য।তাই মুমুর মা’ও পাত্রপক্ষের সবরকমের আব্দার পূরণে সচেষ্ট থাকেন তা ন্যায়ই হোক কি অন্যায়।
অনুষ্ঠান শেষে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো।মুমুর মনটা খুব খারাপ।ঐ অনুষ্ঠানে জিসান তার বোন আর বোনজামাইয়ের সামনেই মুমুকে নিয়ে নাচানাচি করার জন্য কয়েকবার টানাটানি করেছে,
মুমু প্রতিবারই হাত ছাড়িয়ে সরে এসেছে।কয়েকবার তাগাদা দেবার পর জিসান তাকে বাড়ী পৌঁছে দিতে বের হয়েছে।নইলে আরো রাত বাড়তো!
ঢাকা শহরে রাত দশটা এমন কোনো রাত না কিন্তু আবাসিক এলাকাগুলো রাত আটটা বাজলেই নিরব হয়ে পড়ে।তেমনি একটা এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলো ওরা।হঠাৎ জিসান গাড়ী থামাল।মুমু চমকে উঠল।
-“গাড়ী থামালেন কেন?”
জিসান হাসল-“তোমাকে একা পাবো বলে!”
-“ম্..মানে?”(মুমুর বুক কাঁপছে)তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হবে নইলে মা চিন্তা করবেন!”
-“উঁহুঁ….তোমার মা ভালো করেই জানে তুমি কার সাথে আছো তাই রাতে যদি আমরা নাও ফিরি তবু তিনি টেনশন করবেননা!”বলে জিসান হঠাৎ মুমুর হাত চেপে ধরলে মুমু ধমকে বলে -“এসব কি হচ্ছে?”
-“প্লিজ,চলোনা…আজকের সময়টা আমরা নিজেদের মত কাটাই!শাওনের ফ্ল্যাটটা একদম খা…..”!
জিসানের কথা শেষ হবার আগেই মুমু গাড়ীর গেট খুলে নেমে পড়ল।এটা দেখে জিসানও দ্রুত নেমে পড়ল-“এই কি হলো নামলে যে?”
-“আমি আপনার সাথে যাবোনা,রিক্সা নেবো সামনে গিয়ে,আপনি চলে যান!”বলে মুমু আঁচলটা টেনে মাথা সহ পুরো উর্ধাংশ ভালোভাবে আবৃত করল।জিসান দৌড়ে ওকে ধরে গাড়ীর সাথে চেপে ধরল-“উফ্…
তোমার এই পালাই পালাই ভাবটা আমাকে তোমার আরো কাছে চুম্বকের মত টানে!”বলে মুমুর ঘোমটা দেয়া মুখটা ভালকরে দেখে বলল-“ঘোমটা তোমার রূপে বাড়তি সৌন্দর্য্য যোগ করেছে!প্লিজ,
আর কিছু না হোক একটা চুমু তো ফ্রি তে পেতে পারি কি বলো!”
-“ছাড়ুন আমাকে,রাস্তার মধ্যে এসব কি শুরু করেছেন?লোকজন দেখছে!”
-“লোকজন কোথায় পেলে তুমি?দুইপাশে লেক আর ঐ দুইপাশে রাস্তা।জনমানবহীন এ প্রান্তরে তুমি আর আমি আদিম হতে বাধা নেই!আর :কিছুদিন পর তো আমরা এক হবোই,এখনি তাহলে বাধা কিসে…বলো?
“বলে মুমুকে একপ্রকার জোর করেই গাড়ীতে ঢোকালো!
মুমু বুঝতে পারলো আজ জিসানের লোভ থেকে সে বাঁচতে পারবেনা যদি সরব না হয়!ভাবনাটা মুমুর শরীরে বাড়তি শক্তি এনে দেয় তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে জিসানকে ধাক্কা দিলে ওর মাথাটা গাড়ীর ছাদের সাথে ঠুকে যায়!
জিসান মাথা ধরে সিটে বসে পড়লে মুমু ওকে দ্বিতীয় ধাক্কা দিয়ে পাগলের মত গাড়ীর ভেতর থেকে বের হয়ে আসে!দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে মুমু সামনের দিকে দৌড় দেয়।আঁচলটা দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব পেঁচিয়ে নেয়।
তখনি দেখতে পায় দুজন যুবক হেঁটে এদিকেই আসছে!
মুমু থেমে যায়,ছেলেগুলো ভালো না মন্দ জানার উপায় নেই,
বলা যায়না ওর অবস্থা ফ্রাইপ্যান থেকে চুলার আগুনে পড়ার দশা হতে পারে।মুমু একটি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেল।ছেলে দুটো ওকে ক্রশ করে চলে যাচ্ছে।
মুমুর খুব ইচ্ছে হলো ওদের ডেকে সাহায্য চায় কিন্তু ভয় হয় যদি ওরা জিসানের মতই মন্দ লোক হয়?
ছেলে দুটো চলে গেছে কিনা দেখার জন্য আরেকবার উঁকি দিতেই চমকে উঠল,ছেলেদুটোর একজন হলেন শান্তর টিচার!মুমু তার নাম জানেনা কি বলে ডাকবে ভেবে ছেলেদুটোর দিকে দৌড় দিল,তারপর পেছন থেকে ডাকল-“এই যে শুনছেন?”
পরিচিত একটা কন্ঠ শুনে ফারুক ফিরে তাকিয়ে শান্তর বোনকে দেখে চমকে গেল।মুমু দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল-“আমি খুব বিপদে পড়েছি..প্লিজ আমাকে হেল্প করুন!”
-“এতো রাতে আপনি এখানে কেন?”
-“জ্..জিসানের সাথে এসেছিলাম…. কিন্..তু…!”আর বলতে পারলোনা মুমু।সে বাঁশপাতার মত থিরথির করে কাঁপছে!
ফারুকের সাথের বন্ধুটি ফারুককে বলল-“তুই চিনিস ওকে?”
-“হমম….শান্তর বোন্..!”
ফারুক আর কোনো প্রশ্ন না করে মুমুর দিকে একবার তাকিয়ে বলল-“আসুন!”
বলে বন্ধুটির সাথে হাত মিলিয়ে তাকে বিদায় দিয়ে হাঁটা ধরল ফারুক।
মুমু ওর পেছনে রীতিমত দৌড়াতে লাগল কারন ফারুকের সাথে সে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছেনা,বারবার পিছিয়ে পড়ছে!মেইন রোডে এসে ফারুক একটা রিক্সা ডাকল!তারপর তাতে মুমুকে উঠতে বলল।মুমু উঠে সরে বসল।
ফারুক একটু বিরক্তি নিয়েই রিক্সায় উঠে বসল!
কিছুদুর যেতেই মুমুর ভয় কিছুটা কাটাল।সে নিচু স্বরে বলল-“আপনি আমাকে খুব খারাপ ভাবছেন,তাই না?”
-“আমার ভাবনায় তো আর আপনার কিছু যায় আসেনা!অতএব বাদ দিন এসব কথা..!”বিপরীত দিকে তাকিয়ে বলল ফারুক।সে যথাসম্ভব সরে বসেছে,হাত দুটোকে দুপায়ের মাঝে পরস্পর মুঠো করে ধরে রেখেছে।
তারপরও সামান্য ঝাঁকিতেই দুজনের গায়ে গা লেগে যাচ্ছে।মুমুদের বাসার কাছাকাছি আসতেই ফারুক রিক্সাওয়ালার পিঠে হাত দিয়ে থামতে বলে নেমে পড়ল।তারপর পকেট থেকে ভাড়া বের করে রিক্সাওয়ালার হাতে দিয়ে বলল-
“ওনাকে নামিয়ে দিয়ে এসো!”
তারপর মানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে সেটা ভাঁজ করতে করতে বলল -“যেতে পারবেন না এবার?”
-“জ্বী,পারবো…আপনাকে অনেক…..’ধন্যবাদ’শব্দটা বলার আগেই ফারুক হাঁটা ধরল।মুমু সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রবের শুকরিয়া আদায় করল।
বাসায় ফিরে বেল বাজাতেই মা দরোজা খুলে ওকে জড়িয়ে ধরলেন-“কোথায় ছিলি তুই?আমি চিন্তায় অস্থির!একা আসলি কিভাবে?”মা একনাগাড়ে প্রশ্ন করে চললেন!
মুমু হকচকিয়ে গেল,মা কি ভাবে জানলো যে পথে কোনো সমস্যা হয়েছে?মুমু কি বলবে ভেবে পেলোনা।ড্রইং রুমের পর্দা তুলতেই মুমু ভীষণ চমকে উঠল।
জিসান সোফার মধ্যে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে!
মুমুর চেহারা কঠিন হয়ে গেল।মা পেছন থেকে বলতে লাগলেন-“ছিনতাইকারীরা দেখ কি করেছে, জিসানের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে!জিসান এই অবস্থায় বাড়ী না গিয়ে এতো রাতে তোকে খুঁজতে বাড়ী এসেছে।জিসান মুখ গম্ভীর করে বলল-
“তোমার ওভাবে দৌড় দেয়াটা উচিত হয়নি..বাজে কারো খপ্পরে পড়তে পারতে!ওখানে তো আমি ছিলাম!আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিতাম না!তুমি একা এতটা পথ আসাটা উচিত হয়নি..!”
মা জিসানকে বললেন-“তোমাকে একটু দুধ গরম করে দেই বাবা!বসো!”
মা উঠে গেলেন।মুমু পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।ঘুরে চলে আসতে নিলে জিসান পেছন থেকে বলল-“কি ভেবেছিলে,এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে দেবে?হা হা হা…ওটি হতে দেবোনা! বিয়ে তো তোমার আমার সাথেই হবে তারপর বাসর….
“জিসানের কথার মাঝপথেই মুমু ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে চলে এলো সেখান থেকে!
জাহিদের বিয়ে হয়েছে আজ চারদিন হলো!এই চারদিনেই কুমকুম সবাইকে আপন করে নিয়েছে।
শ্বশুড় শ্বাশুড়ী মহা খুশী কুমকুমের আচরণে।কেবল জাহিদ নিজেই স্বাভাবিক নয়।সে নিজে থেকে কোনো কথা বলেনা।কেবল কুমকুম প্রশ্ন করলে জবাব দেয়।জাহিদ বাবাকে তাগাদা দিলো তার বার এট ল’র ব্যাপারে!জাহিদের বাবা জানালেন,
তিনি টাকার ব্যবস্থা করে রাখবেন।পরের বার এসে জাহিদ টাকাটা নিয়ে যাবে অথবা ব্যাংকের মাধ্যমে পেয়ে যাবে!
আগামী শনিবার জাহিদ ঢাকা চলে যাবে।কুমকুমের মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে।সে জানেনা তার দোষটা কি!বিভিন্নভাবে জাহিদকে প্রশ্নটা করেছে কিন্তু জাহিদ পরিস্কার করে কোনো উত্তর দেয়নি!
সারাদিন তো এদিক সেদিক করে কাটিয়ে দেয়।রাত হলে ঘরে ঢুকে নিজের মত করে ঘুমিয়ে পড়ে,কোনো কথাই হয়না ওর সাথে।কুমকুম ঠিক করলো জাহিদ চলে যাবার আগে ওকে চেপে ধরবে, কেন সে এতো বিমুখ হয়ে আছে!
রাতে ঘরে ঢুকেই জাহিদ নিজের পাশে বালিশটা ঠিকঠাক করে শুতে যাবে তখনি কুমকুম এসে ওর পায়ের কাছে বসে।জাহিদ সেদিকে বলে-“পায়ের কাছে বসেছো কেন?সরো ঘুমাতে দাও!”
-“জ্বী,ঘুমাবেন তো অবশ্যই কিন্তু আমার কিছু কথার জবাব দিয়ে তারপর ঘুমান !”
জাহিদ উঠে বসল-“কি কথা?”
-“আমি কি আপনার কাছে কোনো অপরাধ করেছি?”
-“নাহ্…অপরাধ করেছো কেন বলছো?”
-“তাহলে আমার সাথে এমন করছেন কেন?”
-“কই….কি করছি?”
-“আমি আপনার নব বিবাহিতা স্ত্রী,অথচ আপনি আমার সাথে কোনো কথাই বলেন না!আমার দ্বারা যদি কোনো বেআদবী হয়ে থাকে বলুন,নিজেকে শুধরে নেবো,আর যদি আমাকে পছন্দ না হয়ে থাকে তাও বলুন…!”
-“বললে কি করবে?”
-“আব্বাকে বলে বাড়ী চলে যাবো! তিনি আপনাকে আপনার পছন্দের পাত্রীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন!”
জাহিদ চমকে উঠল-“আমার পছন্দের পাত্রী?কে বলেছে তোমাকে?”
-“কেউ বলতে হবে কেন!আপনি সেদিন ঘুমের মধ্যে মেঘা নামের একটা মেয়েকে ডাকছিলেন।তারপর আমি আপনাকে ছুঁয়ে দিতেই আপনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন….আমাকে বলবেন,এই মেঘাটা কে?”
জাহিদের চোখ থেকে ঘুম পালালো!কুমকুম যদি সত্যি সত্যিই আব্বাকে বলে দেয় তো বিদেশে ব্যারিস্টারী পড়তে যাওয়া তো হবেইনা উল্টো আরো কাহিনী হবে!
জাহিদকে চুপ দেখে কুমকুম আস্তে করে বলল-“মেঘা নামের মেয়েটি বোধহয় আপনার বান্ধবী যাকে আপনি ভালোবাসেন,তাই না?”
জাহিদ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল-“তুমি ওয়াদা করো আব্বা আম্মাকে কিছু বলবেনা এ ব্যপারে?”
কুমকুম ম্লান হাসল-“,ওহ্,আব্বার ভয়ে তাহলে বিয়েটা করা হয়েছে!”
জাহিদ বিপর্যস্ত বোধ করল।এভাবে কুমকুমের হাতে নাজেহাল হতে হবে ভাবেনি!কুমকুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“বলুন,আপনার কথা!নিশ্চিন্ত থাকেন আমি কাউকে বলবোনা!”
জাহিদ কিছুক্ষণ থেমে বলল-“মেঘা আমার ডিপার্টমেন্টে পড়ে।বিগত ছয় বছর ধরে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব!”
-“নাউযুবিল্লাহ,ছয়টি বছর ধরে আপনি জেনায় লিপ্ত আছেন?”
-“দ্যাখো,এটা যে জেনা না কি আমি তা বুঝিনা..ঢাকার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবেই ছেলেমেয়েরা পরস্পর এনগেজড হয়!”
-“তাদের সবার বিয়েও হয়?”কুমকুম অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
জাহিদ মাথা নাড়ল-“না,সবার হয়না,কারোটা হয় কারো ব্রেকাপ ঘটে,কারো অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়…এসবই এখনকার সমাজে প্রচলিত।”
-“কি ভয়ংকর!”
-“কেন তোমার কোনো পছন্দের মানুষ নেই?ওহ্,তুমি তো কারো সামনে যাওইনা!”জাহিদ সামান্য হাসলো!
-“কে বলেছে নেই?অবশ্যই আছে!”
জাহিদের মুখের হাসি মুছে গেলো-“কি বলো? কে সে?”
-“টপ সিক্রেট,বলা যাবেনা!”
জাহিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার আর মেঘার সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়িত্বের কথা,দুজনের প্ল্যান,বাইরে যাওয়া সবই বলল।কুমকুম মন দিয়ে শুনল।
তারপর বলল-“এখান থেকে ফিরে গিয়ে নিশ্চয়ই তার সাথে বন্ধুত্ব রাখবেন,নাকি রাখবেন না!”
-“ওকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না!'”
জাহিদের কথার ধরনে কুমকুমের চোখে পানি এসে গেলো।আড়ালে তা মুছে বলল-“একটা অনুরোধ করবো রাখবেন?
জাহিদ তাকালো-“কি?”
-“আপনি যদি মেঘার সাথে বন্ধুত্ব রাখেন তবে ওকে অবশ্যই বিয়ে করে নিজের জন্য হালাল করে নেবেন আর যদি বিয়ে না করেন তবে সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলুন!”
জাহিদ হতভম্ব হয়ে বলল-“তুমি তো অদ্ভুত মেয়ে..!নিজের ম্বামীকে বিয়ের পরামর্শ দিচ্ছো!”
-“আপনি কারো সাথে জেনা করছেন এটা শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু আপনি আপনার অন্য স্ত্রীর কাছে আছেন,এটা ততটা খারাপ লাগবেনা,যেটুকু লাগবে তা হলো ঈর্ষা।আর আমি ঈর্ষাকাতর নই!
-“শুনেছিলাম,মেয়েরা নাকি সব কিছুর ভাগ দিতে পারে কিন্তু নিজের স্বামীকে ভাগ করতে পারেনা,তোমার বেলায় দেখছি উল্টো!”জাহিদ অবাক হয়ে বলল।সে বুঝতেই পারেনি কুমকুম এতো সহজে মেঘার বিষয়টা মেনে নেবে।
কুমকুম ম্লান হাসল-“বিষয়টা আসলে ভুলভাবে দেখা হয় বলেই এই সমস্যা।মানুষের সবচে প্রিয় তার সন্তান।যার মুখের দিকে তাকিয়ে সে হাসিমুখে সারাজীবন পার করে দিতে পারে সেই সন্তান একটা হোক কি দশটা ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায়না!
অথচ কোনো মানুষ বিনা সন্তানে কেবল স্বামী-স্ত্রীর দিকে কিংবা স্ত্রী স্বামীর দিকে তাকিয়ে জীবন পার করতে পারেনা।সে সন্তানের জন্য তড়পায়,কাঁদে অথচ সেই সন্তানকে সে স্বামীর সাথে বা অন্য সবার সাথে ভাগ করতে কষ্ট পায়না!
আসলে এর মধ্যে অনেক বড় একটা স্বার্থপরতা লুকিয়ে আছে!
-“তুমি আমাকে বিস্মিত করলে!তুমি কি সত্যি চাও আমি মেঘাকে বিয়ে করি?”
-“সম্পর্কের হালাল পদ্ধতি হচ্ছে বিয়ে,আপনি বলছেন তাকে আপনি ভালোবাসেন,কষ্ট দিতে চাননা তাহলে বিয়ে না করে এসব কিভাবে করবেন?”
জাহিদ অবচেতন মনেই তাকিয়ে রইল কুমকুমের দিকে।কুমকুম উঠে দাঁড়ালে জাহিদ হঠাৎ কি মনে করে ওর হাতটা ধরে ফেলল-“তোমার অধিকার নিয়ে তো কিছু বললেনা!”
-“সেটা একান্তই আমার থাক্…!”কুমকুমের চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো!জাহিদ কিছুটা বিচলিত বোধ করল।কুমকুম সরে নিজের পাশে চলে গেল।বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল।জাহিদ পেছন থেকে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।
আজ জাহিদ চলে যাবে!কুমকুম নামাজ পড়ে জাহিদের সব কিছু গুছিয়ে হাতের কাছে এনে রাখল!যাবার একঘন্টা আগে জাহিদ যখন তৈরী হচ্ছিল তখন কুমকুম চুপ করে এককোণে বসেছিল।
জাহিদের হঠাৎ খুব মায়া লেগে গেল।
কাছে গিয়ে ওকে দুহাতে ধরে দাড় করালো!কুমকুম চোখ তুলে তাকালো,জাহিদ কি মনে করে কুমকুমকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল।কুমকুম না পাওয়া ভালবাসার অভাবে শুকনো ফুলের মতো ম্লান হয়েছিলো,
শেষ মুহূর্তের এই সঞ্জিবণী সুধাটুকু ওর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করলো।
জাহিদ ওর মুখে মুখ রেখে বলল-“তুমি খুব ভালো…!’
কুমকুম জাহিদের বুকে মুখ রেখে ভেজা কন্ঠে বলল-“আমি ‘অপেক্ষা’য় থাকবো…!”
মুমুর কথা শুনে ওর মা হতভম্ব হয়ে গেলেন-“এ..এসব কি বলছিস তুই?”
-“হ্যাঁ,মা….আমি বেঁচে থেকেও রোজ মরতে চাইনা।জিসান লম্পট চরিত্রের একটা ছেলে!
-“কিন্তু…আপা কি এসব শুনতে চাইবে? উনিতো খুব রাগ করবেন!
-“মা..আমার জীবনের চেয়ে তোমার কাছে অন্যকিছু বড় হলো?জেনেশুনে ঐ কামুক চরিত্রের লোকটার হাতে তুমি আমাকে তুলে দেবে?”মুমুর কথা শুনে মা কিছুক্ষণ নিরব রইলেন!তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-
-“বলা যায়না,বিয়ের পর হয়তো এসব ঠিক হয়ে যাবে!”
-“এটা গৎবাধা মুখস্ত কথা মা!যার চরিত্র নাই তার কিছু নাই।বিয়ের পর সে বাইরে অন্য মহিলাদের সাথে এসব করবে। যাক.. বুঝেছি…তোমাকে বলে লাভ নেই!তুমি আমাকে বুঝিয়ে শুঝিয়ে ওর হাতেই তুলে দেবে,তোমাকে এসব বলে লাভ নেই!”
মা কিছু না বলে উঠে রান্না ঘরে চলে গেলেন।মুমু অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল!তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল!
ভার্সিটির ক্যান্টিনের বাইরে কিছু চেয়ার পাতা আছে ওরা সেখানেই বসে কথা বলছে মেঘা আর জাহিদ।
জাহিদ কিছুটা অন্যমনস্ক আজ।মেঘা ওর কব্জি চেপে ধরে বলল-“,তোমার কি হয়েছে ঠিক করে বলোতো?ফেরার পর থেকে দেখছি তুমি মনমরা যেন বিয়ে করে বৌ ফেলে রেখে এসেছো!”দুষ্টামী করে হেসে বলল মেঘা।কিন্তু জাহিদ হাসলো না।
মেঘার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল।মনের ভেতর তার নানান ভাবনা সমুদ্রের ঢেউয়ের মত একের পর এক আছড়ে পড়ছে।
মেঘা জাহিদের চোখের সামনে তুড়ি বাজালো-“হ্যালো…কাহাঁ খো গায়ে হো তুম?”
জাহিদ কপাল কুঁচকালো-“কি?”
মেঘা হাসল-“এটা হিন্দী ভাষা!এর অর্থ হলো কোথায় হারিয়ে গেছো তুমি?”
-“খুব সিরিয়াল দেখো বুঝি…?”
-“না দেখলে ঘুমই আসেনা..!”
জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুহাতে মুখ ঢেকে মিনিট খানেক ভাবল-“মেঘাকে আজ সব সত্য বলেই দেবে।মিথ্যের উপর সে তার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়না!
কুমকুম যদি স্ত্রী হয়েও মেঘাকে বিয়ে করার মত উদারতা দেখাতে পারে তাহলে মেঘাতো তার ছয় বছরের পুরোনো বন্ধু!সে নিশ্চয়ই জাহিদের অবস্থা বুঝবে,কুমকুমকে মেনে নেবে!
মেঘার ধাক্কায় ঘোর কাটল-“আরে কি ভাবছো এতো?”
জাহিদ মেঘার দিকে তাকাল-“মেঘা,তোমাকে একটা জরুরী কথা বলবো!”
-“বলো!”
-“আম্…আমি…মানে দেশে যাবার পর বাবা… হুট করে আমার মতামত না নিয়ে একরকম চাপ দিয়েই..মানে…বি…বিয়ে..করিয়ে দিয়েছে!”বলে জাহিদ মেঘার মুখের দিকে তাকালো!মেঘা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
জাহিদ বুঝলো এটা ঝড়ের পূর্বাভাস।ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি কেমন থমথমে হয়ে যায় এটা সেরকমই!
মেঘা আস্তে করে বলল-“কি বলেছো তুমি?”
জাহিদ ওর হাত ধরতে গেলে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মেঘা-“হোয়াট ডিড ইউ সে?”
….
তারপরের ঘটনা না লেখাই ভালো।
কান্না-রাগ-জেদ-চলে যাওয়া-হাতপা ধরা-ফোন না ধরা-গালাগালি করা”……এসমস্ত ঝড় বয়ে যাবার পর একসময় প্রকৃতি শান্ত হলো।প্রায় এক সপ্তাহ রাগ করে থাকার পর আজ মেঘা নিজেই ফোন দিয়েছে জাহিদকে!
-“কফি হাটে এসো,জরুরী কথা আছে তোমার সাথে!”বলে ফোন কেটে দিল মেঘা।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মুখোমুখি হলো ওরা!
মেঘা শান্ত স্বরে বলল-“আমাকে বিয়ে করতে চাইলে শর্ত একটাই…তোমার বউকে ত্যাগ করতে হবে!”
জাহিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-“সে তার জায়গায় থাক্ না..সে তো তোমাকে বিরক্ত করতে আসছেনা।তোমাকে বিয়ে করবোনা একথা তো একবারো বলিনি!”
-” তোমার বউকে ছেড়ে তারপর আমার কাছে এসো!”
জাহিদ মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো! বললো-“সেক্ষেত্রে তোমাকে বিয়ে করাটা কঠিন হয়ে যাবে,কারন বাবা জেনে গেলে তুলকালাম কান্ড হবে।আমার পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যাবে!
তাছাড়া বিয়ে করে তোমাকে নিয়ে ইংল্যান্ড চলে যাবো।কুমকুমকে নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে!”
মেঘা মাথা নিচু করে ভাবল কিছুক্ষণ।তারপর মুখ তুলে বলল-“ওকে,বাবার সাথে কথা বলে জানাবো..!”
সেদিনই বাড়ী থেকে ফোন এলো জাহিদের।বাবাই জানালেন যে তিনি টাকাটা ব্যাংকে জমা দিয়ে দিয়েছেন।জাহিদও তার “বার-এট-ল’র ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিয়ে দিলো।
পরের সপ্তাহেই মেঘার সাথে বিয়ে হয়ে গেলো জাহিদের।
“বার এট ল এবং হানিমুন”-এক ঢিলে দুই পাখি মারতে মেঘা আর জাহিদ উড়াল দিলো ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।জাহিদের বাবা একবার বলেছিল বিলেত যাবার আগে একবার দেশে ঘুরে যা,
মা আর বউয়ের সাথে দেখা করে যা।জাহিদ জানালো সে সময় হাতে নেই,তাই সে দেশে যেতে পারবেনা!তবে ল্নন্ডন পৌঁছে ঠিকানা মেইল করে দেবে!
জাহিদ আসলে কোনো মায়ার বাধনে জড়াতে চায়না।জাহিদ ভালো করেই জানে কুমকুমকে এড়িয়ে থাকাটা তখন ওর জন্যে কঠিন হয়ে উঠবে।
আজ মুমুর গায়ে হলুদ।
আগামী কাল আকদ হবে।
চারপাঁচটা ভ্যান গাড়ীতে করে প্রচুর ডালা এসেছে।তাতে শাড়ী গহনা থেকে শুরু করে ফুল,ফল, কসমেটিকস সবই আছে।
জিসানই হঠাৎ সিদ্ধান্তটা নিয়েছে।মুমুর মা প্রস্তুত ছিলোনা এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য।জিসানদের পক্ষ থেকে চাপ এলো যে দেরী করা যাবেনা!
গায়ে হলুদ মেখে ফুলের গহনা পড়ে পাথরের মত মুখ করে বসে আছে মুমু।
ফারুক বেল বাজালে শান্ত দরজা খুলে দিয়ে সালাম দিয়ে বললো-“স্যার,কাল আপার বিয়েতো…..আজ গায়ে হলুদ,তাই আম্মু ছুটি দিতে বলেছে!”
ফারুক জিজ্ঞেস করল-“হমম,তা ঠিক আছে কিন্তু তোমার মুখ গোমড়া কেন?এটা তো আনন্দের কথা!”
শান্ত চোখ মুছল।ফারুক ওর হাত ধরে সোফায় বসল-“কি হয়েছে,মন খারাপ কেন?”
-“বড়খালা আপুকে কাল অনেক মেরেছে কারন আপু জিসান ভাইয়াকে বিয়ে করতে চায়না।জিসান ভাইয়া নাকি ভালো না।কিন্তু বড়খালামনির ভয়ে আজ আপু বউ সেজেছে…!”
ফারুকের মুখ বিবর্ণ হলো-“জিসান?এটা তো সেই ছেলেটা যার নাম শাস্তর বোন সেদিন রাতে বলেছিলো!ফারুক সেদিন কিছু জানতে চায়নি বলে জানা হয়নি কিন্তু এখন ঘটনা কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে।
ফারুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“তোমাকে কি শিখিয়েছি,যখনি কোনো সমস্যায় পড়বে তখনি মনে মনে আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে সাহায্য চাইবে?তিনিই সব সমস্যার সমাধানকারী!আচ্ছা,আমি গেলাম…কবে পড়াতে আসতে হবে জানিয়ে ফোন দিও!”
শান্ত মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল।ফারুকও দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেল।
জাহিদ নতুন জীবনে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ল।পড়াশোনা-নতুন সংসার নিয়ে দুজনই মহা ব্যস্ত।দুজনেই পালা করে পড়ে আর ফাঁকে ফাঁকে শহরটা ঘুরে দেখে।বেশ কিছু নতুন বন্ধুও জুটে গেল তাদের দুজন আবার বাঙালী।
নতুন ঠিকানা মেল করার পর গতমাসে আব্বার একটা চিঠি এসেছিলো যে,কুমকুম কিছুটা অসুস্থ।চিঠিটা পেয়ে জাহিদ আনমনা হয়ে পড়েছিল।
মেঘা খুব বিরক্ত হয়েছিল সেদিন।সে লক্ষ্য করেছে গ্রাম থেকে চিঠি আসলেই জাহিদ কেমন অন্যমনস্ক থাকে সারাটা দিন।মেঘা তখনি সিদ্ধান্ত নিলো তাদের উজ্জল ভবিষ্যতের স্বার্থে জাহিদকে এসব সিলি পেইন থেকে দুরে রাখতে হবে।
যার ফলে মায়ের প্রচন্ড অসুস্থতা এবং তার পর তাঁর মৃত্যু সংবাদ,কুমকুমের আবেগ ভালোবাসা সব কিছু খামবন্ধ অবস্থায়ই ডাষ্টবিনে আশ্রয় পেল।জাহিদ তার কিছুই জানলোনা।
সেকারনেই কিনা কে জানে প্রথম সেমিষ্টার পরীক্ষায় জাহিদ ডিস্ট্রিংশান মার্কস পেয়ে সবার মুখ উজ্জল করলো!এখন সেকেন্ড সেমিষ্টারের প্রস্ততি চলছে।এরই মাঝে একবছর সময় পেরিয়ে গেছে!
জাহিদের বাবাও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন!স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছেন।কুমকুম আর কেয়ারটেকার চাচা মিলে তার দেখাশোনা করে।
পাশাপাশি কুমকুম তার মাদ্রাসাটাও দেখাশোনা করে।এটা না থাকলো ওর জন্য সময় কাটানো মুশকিল হয়ে যেতো।
প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের পাটিতে জাহিদের সুস্থতা ও সফলতা কামনা করা ওর নিত্যদিনের কাজ।
বিয়ের আকদ পড়ানোর আগে দিয়ে মুমু খুব কাঁদছিলো।শান্ত বোনকে এমন কাঁদতে দেখতে পারলোনা।নিরবে মায়ের ঘরে গিয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলল আকাশপানে,”ওগো দয়াময়..আমার আপুর কষ্ট দুর করে দাও,ওর কান্না মুছে দাও!”
বলে শান্ত নিজেও কেঁদে ফেলল।
মুমু বৌ সেজে বসে আছে।বরযত্রীও এসে গেছে..প্রচুর পটকা আর আতশবাজী ফোটানো হচ্ছে,পটকা ফাটার শব্দে কানে তালা লেগে যাবার দশা।
জিসানের খুব শখ ছিলো স্টার প্লাস স্টাইলে বিয়ে করবে তাই প্রায় লক্ষ টাকা খরচ করে এসব আতশবাজি ইন্ডিয়া থেকে আনিয়েছে।
এলাকাবাসী আতশবাজীর ঝলক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।মুমু লাল বেনারসীতে মুড়ে ঘরের এককোণে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে।ওর সাথের মেয়েরা সব আতশবাজী দেখতে ছাদে দৌড় দিয়েছে!
হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা উড়ন্ত আতশবাজী মুমুর আচলে পড়ামাত্রই সানথেটিক আঁচলে দাউ দাউ করে আগুন লেগে গেল।মুমু প্রথমে টের পায়নি পরে গরম ভাপ লাগাতে চিৎকার দিয়ে উঠে ছুটে যায় বাইরে ওর চিৎকার শোনার মত সেখানে কেউ নেই।
সবাই ছাদে।কেবল মুমুর মা’শান্তর টিচারকে বেতনের টাকা দেবার জন্য ডেকেছিলেন বলে ড্রইংরূমে তার সাথে কথা বলছিলেন।চিৎকার শুনে মুমুর মা দৌড়ে বেরিয়ে এসে দেখলেন মুমুর শরীরে দাউদাউ আগুন।
তিনি প্রবল চিৎকার দিলে ফারুক দৌড়ে এসে হাতের কাছে শরবতের একটা ছোটখাট বালতি পেয়ে সেটাই উপূড় করে ঢেলে দিলো মুমুর মাথার উপরে।মুমু সংজ্ঞাহীন হয়ে গেল।ততক্ষণে সবাই ছুটে এসেছে।বড়খালা..
জিসান সবাই হতভম্বের মত তাকিয়ে আছে।ফারুক দ্রুত মুমুকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে জিসানকে বলল-“আপনার গাড়ীটা বের করুন!”
জিসান হতভম্ব ভাব কাটিয়ে দ্রুত দৌড় দিলো!আধাঘন্টার মধ্যেই মুমুকে বার্ণ ইউনিটে আনা হলো।
নববধূর বেশে আধাপোড়া মুমুকে দেখে ডাক্তাররা নিজেরাই হকচকিয়ে গেল।জিসান বিমূঢ় হয়ে এককোণে দদাঁড়িয়ে রইল!তাড়াতাড়ি মুমুকে ইমারজেন্সীতে নেয়া হলো!ইতোমধ্যে বড়খালা সহ বাকীরা এসে পড়েছেন।
ডাক্তারদের একজন এসে ফারুককে জানালেন,দ্রুত টাকা জমা দিয়ে বন্ড পেপারে সই দিন,রুগীর অপারেশন লাগবে!”
ফারুক হাতের ইশারায় জিসানকে দেখায়ে বলল-“উনি মেয়ের গার্জিয়ান, ওনাকে বলুন!”
বড়খালা জিসানকে বললেন-“জিসান তুমি সই করে দাও,বাবা!টাকার ব্যবস্থা আমরাই নাহয় করবো।”
জিসান হঠাৎ উঠে দাঁড়াল!খেঁকিয়ে উঠে বড়খালাকে বলল-“এসব ব্যপারে আমাকে টানবেন না!মানবিকতার খাতিরে গাড়ী করে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছি!সব দায়িত্ব আমি কেন নেবো,আমার কি বিয়ে হয়েছে নাকি?আমি এসবে নেই!”
বলে জিসান তার মাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করল।বড়খালা বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল।তার এখন এমন অবস্থা! না পারছে যেতে না পারছে থাকতে।মুমুর মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে।শান্ত ফারুকের শার্ট ধরে টান দিয়ে বলল-
“স্যার..কিছু একটা করেন,আপুকে বাঁচান!”
ফারুক সম্বিত ফিরে পেয়ে নার্সের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে বড়খালাকে বলল-“আমি যদি সই করি আপনাদের আপত্তি আছে?”
বড়খালা চোখ মুছে দ্রুত বললেন-“না না বাবা…আপত্তি কি করবো!আমাদের মেয়ের জান যায়..তোমাকে আল্লাহই পাঠিয়েছে!”
ফারুক এক মিনিট ভেবে খসখসিয়ে সই করে কাগজটা নার্সের হাতে ফেরত দিলো।তারপর টিউশনিতে পাওয়া পুরো বেতনটাই জমা দিয়ে দিলো!
মুমুর মা হতবাক হয়ে চেয়ে রইল!
জাহিদের বাবার শরীরটা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।এদিকে কুমকুমের বাবা কিছুদিন পরপরই এসে দেখে যান,জাহিদের চিঠি এসেছে কিনা খোঁজ খবর করেন।কিন্তু কোনো খবর নেই বলে তিনি হতাশ হন।কিন্তু কুমকুমের মধ্যে যেন কোনো হতাশা নেই।
জাহিদের আব্বা কেঁদে ফেললেন-“মা’রে তোকে বিয়ে করিয়ে এনে এক কষ্টের মধ্যে ফেলে দিলাম।ছেলেটা এভাবে সবাইকে ভুলে যাবে ভাবিনি!মানুষ একটা চিঠিতো দেয়,ফোন তো করে।সে পুরোপুরি ভুলে বসে আছে আমাদের।
তোর কথা ভেবে হলেও তো ফোনটা করা উচিত।কুমকুম ম্লান হাসলো-“এসব ভেবে আপনি ভারাক্রান্ত হবেন না বাবা!ওপরে আল্লাহ আছেন।আমি আমার যাবতীয় দুঃখ -কষ্ট তাঁর কাছেই নিবেদন করি।তিনি নিশ্চয়ই উত্তম ফায়সালাকারী!”
কুমকুমের অটল ধৈর্য্য দেখে আব্বা কিছুটা সান্তনা পান।
জিসান বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে।আংটি ফেরত পাঠিয়েছে।মুমুর মাও বড়খালার আদেশে তাদের পাঠানো যাবতীয় সরঞ্জাম ফেরত পাঠিয়েছে!
মুমুর অপারেশন শেষে ওকে বেডে দেয়া হয়েছে।ডাক্তাররা ফারুকের কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন-“জোর বেঁচে গেছেন উনি।থার্টি পার্সেন্ট ইনজিওরড হয়েছে।প্রপার যত্ন এবং চিকিৎসাই উনি সেরে উঠবেন তবে ভেতর থেকে শুকাতে প্রায় তিনমাস লাগবে।
তার আগে ওনাকে ফুল বেড রেষ্টে থাকতে হবে!
মুমুর পুরো দেখাশোনাই ফারুক করছে ঠিকই কিন্তু সে রুমের ভেতরে আসেনা!বাইরে থেকেই খোঁজ খবর করে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে চলে যায়।একদিন ফারুক তার মা’কেও নিয়ে আসে মুমুকে দেখার জন্য।
তিনি মুমুর গালে হাত রেখে আদর করে বলে-“আল্লাহ্,মেহেরবান তোমার মুখটা বেঁচে গেছে।”
এরই মধ্যে নার্স এসে রুম থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে মুমুর ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করে ঔষধ দিয়ে দেয়!”
প্রায় বিশদিন হাসপাতালে থাকার পর মুমুকে আজ বাসায় নেয়া হবে!
বিকেলেই মুমুকে ডিসচার্জ দেয়া হবে।তার ঘন্টাখানেক আগেই ফারুক তার মা’কে নিয়ে উপস্থিত হয়।কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি হঠাৎ মুমুর মায়ের হাত ধরে বলেন-“আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো মুমুকে আমার ফারুকের বউ করে নিতে চাই!
আপনি কি বলেন?”
এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে মুমুর মা দিশেহারার মত বড়বোনের দিকে তাকালেন।বড়খালা ফারুকের মায়ের হাত চেপে ধরে বললেন-“সব জেনেশুনে যে আপনারা মুমুকে নিতে চাচ্ছেন এটা তো আমাদের পরম সৌভাগ্য!”
মুমু এখন কোনরকমে উঠে বসতে পারে।সেই অবস্থাতেই একটা হালকা সুতির ঢোলা জামা পড়ানো হলো মুমুকে।কেবল মাথার জড়োয়া ওড়নাটাতেই মুমুকে বউদের মতো দেখাচ্ছে।কাজী সাহেব হাসলেন-“জীবনে অনেক বিয়ে পড়িয়েছি!মাশাআল্লাহ!
এমন বিয়েও পড়ানোর সৌভাগ্য হলো!”
বিয়ে পড়িয়ে বর কনের জন্য অনেক দোয়া করে তিনি বিদায় নিলেন।একদম ঘরোয়া পরিবেশে মুমুর বিয়েটা হয়ে গেল।শান্তর খুশি আর ধরেনা।
নতুন বৌকে বাড়ী আনা হলো।ফারুকের ঘরটা মা আগেথেকেই গুছিয়ে রেখে ছিলেন।তিনি মুমুকে সাবধানে খাটে বসিয়ে দিয়ে বললেন -“এই হলো তোমার ঘর।তুমি বসো!ফারুক তোমার জন্য ঔষধ আনতে গেছে!”
মুমু লব্জাবনত মুখে কৃতজ্ঞচিত্তে সেই উপকারী বন্ধুর অপেক্ষা করছে।তার জানতেই হবে,কেন এই অসুস্থাবস্থাতেই তাকে বিয়ে করলো ফারুক!
মুমুকে নিয়ে নিজের বাসাটা ঘুরে দেখালেন ফারুকের আম্মা।শান্তও এসেছিলো সাথে কিছুক্ষণ আগে ও চলে গেছে কারন ওর সামনে পরীক্ষা!বাসাটা ছোটখাটর মধ্যে সুন্দর, ছিমছাম করে গোছানো!
শেষে মুমুকে নিয়ে ফারুকের রূমে বসিয়ে ওর মা বলতে লাগলেন-“আমার ফারুকের মত ছেলে হয়না!ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে ও আমার ন্যাওটা!
কখনো আমার কাছে কিছু লুকায়না জানো!যেদিন তুমি পথে বিপদে পড়েছিলে সেদিন ওকে নিয়ে একজায়গায় পাত্রী দেখতে যাবার কথা ছিলো!মেয়ে দেখেও এসেছি।ফারুক আমার পছন্দের উপর ছেড়ে দিলো।আমি মোটামুটি হ্যাঁ,
বলেই দিয়েছিলাম কিন্তু খবর পেলাম মেয়েটা অন্য কাউকে পছন্দ করে।কিন্তু ওর পরিবার আবার ফারুককে পাত্র হিসেবে খুব পছন্দ করেছে।করলে কি হবে?ফারুক তো বেঁকে বসলো!
ও আবার এসব খুব মানে!মেয়েদের খোলামেলা চলা ও একদমই পছন্দ করেনা!পরে আমরাই আর গেলাম না!
মুমু চুপ করে বসে বসে শ্বাশুড়ীর কথাগুলো শুনছিলো।তখনি ফারুক সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল!মুমু সচেতন হয়ে গুছিয়ে বসল,মাথায় কাপড় টেনে দিলো।এসব করতে গিয়ে লক্ষ্য করলো ওর মধ্যে একধরনের ভালোলাগা কাজ করছে।
.
ফারুক একপলক মুমুকে দেখলো।তারপর হাতের ঔষধগুলো বেড সাইড টেবিলে সাজিয়ে রাখল!মা’কে ডেকে বাইরে নিয়ে গেল।মুমু ঔষধগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল!
বুকের ভেতর অপরাধবোধের বোঝাটা আরো বাড়লো।যে মানুষটা চাইলেই একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাততে পারতো সে কেন মুমুর মত সমস্যাক্রান্ত রুগীকে বউ করে নিজের ঘরে নিয়ে এলো!শুধুই সেবা করার জন্য?
কেন স্বল্প আয়ের এই লোকটা এতোগুলো বাড়তি খরচের বোঝা মাথা পেতে নিলো?মুমু যখন এসব ভাবছে তখনি ফারুক এসে খাটের একপাশে বসল।কেন বলতে পারবেনা মুমু লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারলোনা।
লোকটার নিকট ঋণ এতো বেড়ে গেছে যে সারাজীবন তার নিরেট দাসত্ব করলেও বোধহয় কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারবেনা।অন্তত মুমুর তাই মনে হলো!
-“কি ভাবছেন? নাকি মন খারাপ?
মুমু মাথা নাড়ল।ফারুক বলল-“জ্বরটা দেখি? বলে মুমুর কপালে হাত রাখল।মুমু ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল।ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ।প্রিয় পুরুষের বিশ্বাসী ছোঁয়া।
-“না..আল্লাহর রহমতে জ্বর তো তেমন নেই,নাইনটি নাইনের মত হবে,ওটা থাকবেই।মমম…আপনার লাস্ট ড্রেসিং হয়েছে দুপুর দুটোয় নেক্সট ড্রেসিং একেবারে রাতে।
-“নার্স আসবে?”মুখ ফসকে বলে ফেলল মুমু!
ফারুক অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকাল-“আমার অত পয়সা নেই।আমিই ড্রেসিং করবো!কোনো সমস্যা?”
মুমুর নাকমুখ গরম হয়ে উঠল -“আ..আপনি..পারবেন?”
-“ড্রেসিং তো এমন কঠিন কিছুনা”এই প্রথম ফারুক হাসল আর মুমু লক্ষ্য করল হাসিটা হ্রদয়কাড়া।নাকি মুমুরই এমন লাগছে?
-“আমি জানি আপনি হয়ত ভাবছেন কেন হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিলাম।”ফারুক হঠাৎ বলল!মুমু মুখ নিচু করে রাখলো।ফারুক মৃদু হেসে বলল-“এর অনেকগুলো কারন আছে…
আপাতত দুটো কারন বলি…একটা হলো আপনার চলমান অবস্থায় যে ঝড় আপনার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল তাতে আপনাকে একা ছেড়ে আসাটা অন্যায় হতো!
দ্বিতীয়ত আপনি একা লড়াই করে যাচ্ছিলেন একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার মনে হলো আপনার সহযোদ্ধা প্রয়োজন,সুযোগটা অন্যভাবে পেয়ে গেলাম।আম্মার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরী করিনি!”
-“কিন্তু আপনার তো কোন দায় ছিলোনা!”
-“তা ছিলোনা কিন্তু এড়িয়েও যেতে পারছিলাম না।প্রথমে সেই রাতের ঘটনাটা তারপর আপনার বাসায় ঘটে যাওয়া একেরপর এক বিপর্যয়গুলো যার প্রায় কয়েকটা আমার সামনেই ঘটেছে,
আবার কয়েকটা শান্তর কাছ থেকে জেনেছি।বিশেষ করে আপনার বিয়ের দিন ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পর আম্মার সাথে পুরো বিষয়টা নিয়ে আলাপ করি।মা আপনাকে না দেখেই আমাকে কিছু সাজেশন দেন।আমি সেটা মেনে নেই।
ইসলামিক জীবন যাপন আমরা অনেকেই করি কিন্তু কিছু কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা স্বার্থপরের মত সরে আসি।তখন আর ইসলামিক চেতনা আমাদের মধ্যে থাকেনা!
-“আপনি আমাকে ঐ পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে বিয়ে করেছেন?”চরম বিস্ময়ে বলল মুমু!
ফারুক দীর্ঘশ্বাস ফেলল-“দুটো কারন এক্সপ্লেইন করেছি।আরেকটা কারন আছে যেগুলো এ মুহূর্তে বলতে চাচ্ছিনা।তাছাড়া ভালোবেসে বিয়ে না করলে বিয়ের অর্থ তো আর বদলে যাবেনা!ভালোবাসা তো যে কোনো সময় হতে পারে!
বরং বিয়ের পরের ভালোবাসাটাই বেশী মজবুত হয়!”
মুমু মৃদু স্বরে বলল-“এমন বিয়েতে আপনি সুখী হতে পারবেন?”
-“সুখ জিনিসটা আপেক্ষিক,আমি অল্পে তৃপ্ত হতে ভালোবাসি!”
মুমু ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমি কি বলে আপনার কৃতজ্ঞতা আদায় করবো বুঝতে পারছিনা!”
-“ব্যাপারটা এভাবে দেখছেন কেন? আর কৃতজ্ঞতা আদায়ের প্রশ্ন উঠছে কেন?আমি আপনার উপকার তো অন্যভাবেও করতে পারতাম তবু বিয়ে করলাম কেন এটা বোঝার মত বুদ্ধি তো আপনার আছে!”
-“না…সত্যিই বুঝতে পারছিনা!”মুমু বলল!
ফারুক হেসে বলল-“আচ্ছা,একসময় বুঝিয়ে বলবো!এখন আপনি বিশ্রাম নিন!”
মুমু পেছন থেকে বলল-“ই…ই..য়ে ড্র..ড্রেসিংটা আজ না করলে হয়না?
ফারুক সাথে সাথেই জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেলো।
তারপর বলল -“ও..আচ্ছা ..তাহলে..আম্মাকে বলবো!”
বলে আর দাঁড়ালোনা ফারুক।
রাতের খাবারটা একসাথেই খেলো ওরা।খাওয়া শেষে ফারুক আম্মাকে বলল-“আম্মা আমার একটু কাজ আছে,বাইরে যাচ্ছি কিছুক্ষনের জন্য!তুমি একটু মুমুকে ড্রেসিং করে দিতে পারবে!খুব সহজ.. আমি শিখিয়ে দিচ্ছি!”
-“পারবোনা কেন!তা তুই আবার এতো রাতে কই যাবি?”
-“এই একটু বাইরে কাজ আছে!”বলে ফারুক উঠে পড়লো।মুমু মাথা নিচু করে খেয়ে চলল!ফারুক চলে যেতে মুমু ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকল!
..
ফারুকের কথামতো কাঁপা হাতে ড্রেসিং করলেন ওর আম্মা।তারপর মুমুকে বললেন-“শোনরে মা,ফারুক এখন তোর স্বামী!
ওকে স্বামীর পূর্ণ মর্যাদাটাই তোকে দিতে হবে!ওকে পর মনে করবি না,তোর যা সমস্যা সব কিছু তো ওই দেখবে!আর আমি তো আছিই!”
মুমু উত্তর দিলোনা!কানে-ঘাড়ে-পিঠে মলম মাখাতে গিয়ে ফারুকের মা টের পেলেন মুমু লজ্জা পাচ্ছে কারন মুমুর কানটা গরম লাগল তার কাছে।
হেসে বললেন-“দুর বোকা মেয়ে এতে লজ্জা পাবার কি হলো!তোমার শ্বশুড় যখন প্রথম আমাদের বাড়ী এলো……শ্বাশুড়ী তার বিয়ের গল্প শুরু করলেন।তারপর মুমুর হাতে মলমটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন-“সামনে তুমি নিজেই লাগাতে পারবে!
আয়নার সামনে চলে যাও!”বলে তিনি নিজের ঘরে চলে এলেন!
মুমু আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।কাপড় সরিয়ে ধীরে ধীরে আঙ্গুলে করে মলম মাখাতে লাগল।ঝুঁকে পেটে দিতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে, পুরোটা দেখতেও পাচ্ছেনা!
এমন সময় ফারুক সালাম দিয়ে প্রবেশ করল!মুমু কাপড় ছেড়ে দিয়ে আঙ্গুলে মলম নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।ফারুক সেদিকে তাকিয়ে বলল-“কি হলো..ওভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
মুমু মাথা নাড়ল-“না, এমনিই!”
ফারুক ওর বলার ধরনে সামনে এলো!ওর হাত তুলে ধরে দেখল তাতে মলম নিয়েছে তার মানে ও এখনো মলম লাগানোর কাজ শেষ করেনি!
ফারুক মেঘডাকা স্বরে বলল-“কোথায় কোথায় দেয়া বাকী?”
মুমু আড়ষ্ট হয়ে মুখ নামিয়ে নিল!
ফারুক ওর হাত থেকে মলম নিয়ে ফট করে ঝুকে ওকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিল।তারপর ভারী স্বরে বলল-“কই..দেখি..আমাকে দিতে দাও…তুমি পারবেনা!
“বলে মুমু কে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে ওর ক্ষতস্থানে মলম মাখাতে লাগল।মুমু একটা বালিশ নিজের মুখের ওপর টেনে নিলো!
কাজ শেষ হলে ফারুক নিজেই বালিশ সরিয়ে হাসল-“কাজ শেষ।আমার পারিশ্রমিক কই?”
মুমু আবারো লজ্জায় লাল হলো!ফারুক ওর গালে মৃদু চাপড় মেরে হাত ধুতে চলে গেলো!
রাতে ফারুক না ঘুমিয়ে বসে বসে খাতা দেখতে লাগল।মুমু এক পর্যায়ে বলল-“কিসের খাতা?”
-“স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার খাতা!”
-“রাত জেগে দেখবেন?”
-“দিনে তো সময় পাইনা!তুমি ঘুমাও!”
বলে ফারুক কাজের মধ্যে ডুবে গেল।আর মুমু পরম প্রশান্তিতে চোখ বুঁজল।রবের লক্ষ শোকর সে ফারুকের মত স্বামী পেয়েছে!
জাহিদ বাড়ী থেকে শেষ চিঠি পেয়েছে গত বছর।এ বছর আর যোগাযোগ হয়নি বাড়ীর সাথে! মাঝে মাঝে মায়ের কথা মনে পড়ে।
বন্ধুবান্ধব আর পড়াশোনার চাপে জাহিদ পেছনের কথা যেন ভুলেই গেছে!
ভার্সিটি যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলো জাহিদ।মেঘা ওর আগেই বেরিয়ে গেছে!
জাহিদ আলমারী থেকে নিজের একটা শার্ট বের করতে গিয়ে হঠাৎ কুমকুমের একটা ছবি শার্টের ভাঁজের ভেতর থেকে মাটিতে পড়ে যায়।জাহিদ চমকে ওঠে ছবিটা দেখে তারপর ভাবে ছবিটা এখানে এলো কি করে?
সে কিছুক্ষণ ছবিটা দেখল!আনমনেই বলে উঠল স্যরি…কুমকুম!আমাকে মাফ করে দিও!”
মনটা আরো ভারাক্রান্ত হবার আগেই সে ছবিটা দ্রুত নিজের একটা বইয়ের ভেতর গুঁজে রেখে দিলো!দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈরী হয়ে ভার্সিটি চলে এলো!
জাহিদের পশে যে ছেলেটি বসে সে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক।প্রায় সাড়ে ছয় ফিট লম্বা আর সাংঘাতিক আমুদে।সবসময় হৈ হুল্লোড় নিয়ে থাকতে পছন্দ করে!সে জাহিদের হাত থেকে বইটা টেনে নিয়ে ইংরেজীতে বলল-“আজকের অধ্যায়টা খুব টাফ..
সে কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা!”
জাহিদ হেসে বলল-“মাথা মোটা না হলে বুঝতে আজকের চ্যাপ্টারটাই তুলনামূলক ইজি।ছেলেটার নাম সানি ক্রুজ।সে জাহিদের বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে কুমকুমের ছবিটা পেয়ে হৈ হৈ করে উঠল।জাহিদ চমকে তাকিয়ে দেখল।
সানি আর কয়েকটা ছেলে কুমকুমের ছবি নিয়ে বিভিন্ন রকম মুখোভঙ্গি করছে।সানি বলছে-“হাউ সেক্সী গার্ল…ওয়্যাও..ইজ সী ইওর গার্লফ্রেন্ড..মমম..লাভলি..উউউ..কুল!”
জাহিদের কি হলো কে জানে!মাথায় রক্ত চড়ে গেল-“হে ইউ বাস্টার্ড বলে সানির নাকে ঘুষি দিতেই সানির নাকমুখ লাল হয়ে গেল।সবাই মিলে ধরাধরি করে থামালো!সানি দ্রুত স্যরি বলে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেলো!
…..
রাতে প্রচন্ড মনখারাপ ছিলো জাহিদের। মেঘা একবার শুধু বলল-“আজ ক্লাসে সানির সাথে নাকি সিনক্রিয়েট করেছো?”
জাহিদ কপালে হাত রেখে শুয়েছিলো!মেঘা বললো-“কি নিয়ে বেধেছিলো?”
জাহিদ বলল-“কিছু না…আমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা!”
পরদিন সকালে জাহিদের ঘুম ভাঙ্গল প্রচুর জ্বর নিয়ে সাথে শরীরে লাল গুটির মত এলার্জি নিয়ে।
মেঘা ওকে পেইনকিলার দিয়ে নিজে ভারসিটি চলে গেলো।জাহিদ অনুরোধ করলো-“আজ নাহয় না’ই গেলে!”
-“আরে না….. ইমপর্টেন্ট ক্লাস আছে!”
জাহিদ আর কথা বাড়ালোনা।
জাহিদের জ্বর কমলেও শরীরের এলার্জিগুলো ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করল।জাহিদ নিজেই ডাক্তারের কাছে গেল,তারা প্রথমে এটাকে ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভেবে অষুধ দিলো তারপর মাসখানেক পর আবার ঐ অষুধ বদলে অষুধ দিলো!
এভাবে ছয়মাসের মধ্যে লন্ডনের সব বড় বড় ডাক্তার দেখানো হয়ে গেলো জাহিদের।
ডাক্তাররা অবশেষে বললেন’এটা একটা রেয়ার স্কিন ডিজিজ,এর কোনো চিকিৎসা নেই।এবং এটি ছোঁয়াচে!”
এই কদিনে জাহিদের সর্বাঙ্গে এলার্জিটা ছড়িয়ে পড়ল।সপ্তম মাসের মাথায় জাহিদ জানালো সে চোখে ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে।সেই ডাক্তার জানালেন”এগুলো তার স্কিন ডিজিজের সাইড ইফেক্ট এবং ধীরে ধীরে সে অন্ধ হয়ে যাবে!
সব শুনে মেঘা সবরকম চিকিৎসা শেষে হতাশ হয়ে জাহিদকে বলল-“স্যরি..জাহিদ.. তোমার জন্য আমি আমার লাইফকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারবোনা!
মেঘা জাহিদকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের মত সরে গেল।জাহিদ নিজেকেই অভিশাপ দিলো-“এসবই আমারই কৃতকর্মের ফল!”
বহু কষ্টে লোক ধরে দেশে ফেরার টিকিট যোগাড় করলো।কারন চোখ যেভাবে ঝাপসা হচ্ছে,সামনে দেখাই না বন্ধ হয়ে যায়!এমনিতেই ওর ছোঁয়াচে স্কিন ডিজিজের জন্য কেউ সহজে ওর কাছে ভিড়তে চায়না!
তার উপর এই বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে মরে থাকলেও কেউ খোঁজ নিতে আসবেনা!”
জাহিদ বার এট ল’র কোর্স কমপ্লিট না করেই দেশে উড়াল দিল।সোজা সিলেট এয়ারপোর্টে এসে নামল ওর প্লেন!জাহিদ চোখে একদম দেখেনা বললেই চলে!এয়ারপোর্ট থেকেই লোক ধরে বহু কষ্টে নিজের গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছুলো!
ঞশ্বশুড় আব্বাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে কুমকুম কুরআন শরীফ পাঠ করতে বসলো!শ্বশুড় আব্বা বললেন-“তোর পড়া হলে একটু আসিস তো মা…কিছু কথা বলবো তোর সাথে!
কুমকুম মাথা নাড়ল-“জ্বী,আব্বা!
কিছুক্ষণ পর কুরআন শরীফ তুলে রেখে আব্বার সামনে এসে বসলো কুমকুম!
-“জ্বী..বলুন আব্বা..!”
-“মাগো..তুই আর কতদিন এভাবে নিজেকে ‘অপেক্ষা’ করিয়ে রাখবি..?তোর নিজেরও তো একটা ভবিষ্যত আছে!আমি বলি কি…তুই নিজের জীবন নিয়ে আরেকবার ভাব্..”!
-“আব্বা..আপনি বলছেন এ কথা..!”
-“হ্যাঁ..বলছি।কারন তুই আমার মেয়ের মত।স্বার্থপরের মত তোকে এভাবে অকারনে আটকে রাখতে পারিনা!তোর বাবা আমাকে কয়েকবার অনুরোধ করেছে তোকে যেন বুঝিয়ে বলি!”
-“বাবা এসব কবে বলল,কই আমিতো কিছু জানিনা?”
-“মা গো…আমার ছেলেটা কুলাঙ্গার বেরিয়েছে।একমাত্র ছেলে বলে ওর সাধ আহ্লাদ সবই পুরো করেছি কিন্তু আজ ও নিজের মায়ের মৃত্যসংবাদ শুনেও একবার খোঁজ নিলোনা!
-“বেআদবী নেবেন না বাবা…ওর এমন তৈরী হবার পেছনে আপনারও কিছু ভূমিকা ছিলো।ওনাকে দুনিয়াবী শিক্ষার পাশাপাশি যদি কিছু দ্বীন শেখাতেন তাহলে বাবা মা’ হক,
স্ত্রীর হক সম্পর্কে তিনি কিছুটা হলেও সচেতন থাকতেন।আমাদের জীবনের কষ্টগুলো আমাদেরই হাতের কামাই আব্বা!”
-“তোর কথা সত্যি!এবার আমাকে বল্..তুই তো কোনো দোষ করিসনি,তুই দ্বীনদার মানুষ। তোকে আল্লাহপাক এতো কষ্ট কেন দিলেন?”
কুমকুম ম্লান হাসল-“আব্বা…এই দুনিয়াটা একটা পরীক্ষাক্ষেত্র।মহান আল্লাহপাক বিভিন্নভাবে আমাদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন!
যখন আমাদের উপর কোন মসিবত আপতিত হবে তখন আমরা তার দিকে তাকাবো যারা আমাদের চেয়ে বেশী কষ্টে আছে!
এটা রাসুল সাঃ এর কথা।তিনি বলেছেন-“যে তোমার চেয়ে বেশী কষ্টে আছে তার দিকে তাকাও তাহলে বুঝতে পারবে আল্লাহ তোমাকে কি নিয়ামত দিয়ে ধন্য করেছেন!
মহান আল্লাহ সবর পছন্দ করেন।সবরের ফল বড় মিষ্টি আব্বা!
যুগে যুগে আমাদের নবী রাসুলগন সবরের চরম পরীক্ষা দিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন।আমিও সেই পথেই হাঁটতে চাই।তার ফল যদি দুনিয়াতে না ও পাই তবে অবশ্যই আখেরাতে এর জন্য পুরস্কার অপেক্ষা করছে ইনশাআল্লাহ !”
-“সবই বুঝলাম মা..কিন্তু দেখতে দেখতে দুটো বছর চলে গেলো,কাল আমার কিছু হলে তুই তো একা পড়ে যাবি তাই বলছিলাম তোর বাবার কথাটা মেনে নে..!”
-“কি বলেছেন বাবা?”
-“তোর কোন্ ফুপাত ভাই আছে রাশেদ নাম।সে গ্রামে এসেছে।সে নাকি বিয়ে করবে পাত্রী দেখা হচ্ছে ওর জন্য।সে নিজেই সব শুনে তোর নাম প্রস্তাব করেছে!”
কুমকুম মাথা নাড়ল-“,না..না..আব্বা..আমি ওনাকে ছাড়া আর কাউকে স্বামীর স্থানে বসাতে পারবোনা!আমার বিশ্বাস উনি একদিন আমার কাছে ফিরবেন,আমার দু’আ বিফলে যেতে পারেনা!”
হঠাৎ পেছন থেকে কুমকুমের আব্বা গর্জে উঠলেন-“কেন,অযথা জেদ করছিস?”
তার পাশে কুমকুমের আম্মাও আছেন!কুমকুমের বাবা বললেন-“আজ আমি তোর কোনো কথাই শুনবোনা।চোখের সামনে বাপ হয়ে এভাবে তোর ফুলের মত জীবনটা নষ্ট হতে দিতে পারিনা!বেয়াই সাহেব ঠিকই তো বলেছে,
তোর নতুন জীবন শুরু করার এটাই উপযুক্ত সময়!”
কুমকুম উঠে দাঁড়ালো,সালাম দিলো।মায়ে হাত ধরে বলল-“আমার অমতে হলেও আপনারা আমাকে জোর করবেন?”কুমকুমের কন্ঠে কান্না ফুটে উঠল!
মা কুমকুমকে জড়িয়ে ধরলেন-“মা,এমন প্রস্তাব বারবার আসেনা।দুটা বছর তো দেখলি,এবার নিজের দিকে তাকা।তোরওতো বয়স বাড়ছে!”
-“আমার স্বামী থাকাবস্থায় আপনারা আমাকে দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন কি করে?”কুমকুম এবার কেঁদেই ফেলল।
শ্বশুড় আব্বা বললেন-“না রে মা…তুই ঐ কুলাঙ্গারকে তালাক দিয়ে ইদ্দত শেষেই তো বিয়ে করবি,তার আগে তো না..! ”
-“না..না..বাবা..আপনাদের দোহাই লাগে,আমাকে এটা করতে বলবেন না!”
-“তুই যদি আজ আমার সাথে না চলিস তো তোর সাথে আমার সম্পর্ক নেই..!”কুমকুমের বাবা শক্ত গলায় বললেন!
-“বাবা…!”বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো কুমকুম।
অবশেষে সেদিনই কাঁদতে কাঁদতে কুমকুম শ্বশুড়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো।
শ্বশুড় নিজেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন-“যা.. মা..সুখী হ..!”!
মুমু রান্নাঘরে ঢুকলে ফারুকের আম্মা বললেন-“সে কি মা,তুই রান্নাঘরে কেন? গরমে আরো খারাপ লাগবে..তোর ঘা তো এখনো পুরোপুরি শুকায়নি..যা ঘরে যা..!”
-“আমাকে কিছু কাজ দিন না মা,সারাদিন শুয়ে থাকতে ভালো লাগেনা!”
-“তাহলে ফারুকের বইখাতা টেবিলটা আর সেল্ফটা গুছিয়ে ফেল।সব এলোমেলো রেখেই বেরিয়েছে!”
মুমু মাথা নাড়ল।
সেলফের বইখাতা গুছাতে গিয়ে হঠাৎ ফারুকের একটা ডায়রী মুমুর হাতে ঠেকল।আনমনে পাতা উল্টাতে থাকল।একটা পাতায় এসে চোখ আটকে গেল।
ওদের বিয়ের পরেরদিনের তারিখ দেয়া…ফারুক লিখেছে-‘.”সেদিনের সেই রাতের পর থেকে মেয়েটা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।কিছুতেই ওকে মন থেকে সরাতে পারছিনা।
এতদিনে আল্লাহ ওকে নিজের করে পাবার একটা সুযোগ করে দিলেন।তবে এটা ছিলো আমার জন্য ঈমানী পরীক্ষা।
মুমুকে বোধহয় মনের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি!বেচারী একটা বদ লোকের পাল্লায় পড়ে বড়শীতে গাঁথা মাছের মত ছটফট করছিলো,সবই দেখছিলাম কিন্তু কিছু করতে পারছিলামনা।সে যে অন্যের বাগদত্তা!”
মুমু পাতা ওল্টালো-“আহ্,আজ ওকে আমার নিজের করে পেলাম।সারা দুনিয়ার মধ্যে সেই একমাত্র আমার জন্য হালাল নারী!কিন্তু তাকে নিজের ভালোবাসা প্রকাশের এটা উপযুক্ত সময় নয়।
কারন সে অসুস্থ!তাছাড়া তার মনেও তো আমার প্রতি ভালোবাসা তৈরী হবার সময় দিতে হবে!’
পরের পাতা-“আজ প্রথম ওর ড্রেসিং করলাম।বেচারী লজ্জায় লাল।আর আমার যে কি হচ্ছিলো সে তো আমিই জানি।কি এক ধৈর্য্য পরীক্ষা মা’বুদ..”!
এতটুকু পরেই মুমু ডাইরী বন্ধ করে বুকের সাথে চেপে ধরল।
তখনি ফারুকের কন্ঠ শুনে দৃশ্যত চমকে উঠল-“কি করছো?”
মুমু বোকার মত ডায়রীটা সহ হাতদুটো পেছনে লুকালো।ঠিক যেমন বাচ্চারা লুকায়।ফারুক এগিয়ে এলো-“হাতে কি দেখি?”
মুমু মাথা নাড়ল-“ন্..না কিছু তো না!”
ফারুক ওর ওপর দিয়ে ঝুঁকে মুমুর হাত দুটো ধরে সামনে আনলো-“এটা কি?”
-“স্যরি..!”
-“চুরি করে অন্যের ডায়রী পড়া উচিত না এটা জানো না?”
মুমু দ্রুত ডায়রীটা সেলফে রেখে দিয়ে চলে যেতে নিলে ফারুক খপ করে ওর হাত চেপে ধরল-“ডাইরী পড়েছো কেন?”
-“পড়িনি তো..!”
-“আবার মিথ্যা..?”
মুমু ধরা পড়া গলায় বলল-“আমি তো..শুধু…”তখনি মা ঘরের দরজা থেকে ডাকলে ফারুকের অন্যমনস্কতার সুযোতে মুমু হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিলো!”
ট্যাক্সি ড্রাইভার লাগেজ সহ সকল মালপত্র উঠানে নামিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল।জাহিদের বাবা লাঠিতে ভর করে ধীরে ধীরে উঠানে হাঁটছিলেন।এমন সময় জাহিদকে দেখতে পেয়ে তিনি ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন।
জাহিদ বাবাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তার পা জড়িয়ে ধরে হাঁটুগেড়ে মাটিতে বসে গেলো।আর তিনি পাথরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন!
আয়নাল মিয়া গত পঁচিশ বছর ধরে এ বাড়ীতে থেকে আসছে।যুবক বয়সে কাজে ঢুকেছে,এখন বৃদ্ধ প্রায়।এবাড়ীর শান শওকত জৌলুস তার চোখের সামনে বেড়ে উঠেছে আর আজ তার চোখের সামনেই বিলুপ্ত হতে চলেছে।
বিশেষ করে জাহিদের এই দুরবস্থা তাঁর মনোকষ্টের বিশেষ কারন হয়ে দেখা দিয়েছে।কিন্তু যে গাছটা এই বাগানটাকে ফুলে ফলে ভরে দিতে পারতো সেই কুমকুমই কিছুদিন আগে বিদায় নিয়েছে।আজ পিতাপুত্রের বিলাপ রোদন দেখা ছাড়া তার আর কিছুই
করার নেই!
জাহিদ মৃত্যুপথযাত্রী।ডাক্তাররা তার আশা ছেড়ে দিয়েছে।তার উপর বাড়ী ফিরে মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে সে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে!
স্ত্রী’র চলে যাওয়াটাকেও সে ব্যথিত মনে মেনে নিয়েছে কারন কুমকুমের উপর সে অধিকার হারিয়েছে।তাছাড়া তার মত আধমড়ার কাছে কুমকুম কি পাবে?বিধবা হতে হবে তাকে।
তারচে তো এই ভালো সে কারো ঘরের ঘরনী হয়ে সুখে জীবন কাটাক।
জাহিদ প্রচুর কাশছে।পানির জন্য হাত বাড়িয়েছে কিন্তু চারিদিক ঝাপসা লাগায় গ্লাসটাও ভালোভাবে নজরে আসছেনা!হাতের ধাক্কায় গ্লাসটা মাটিতে পড়ে গেল।
আয়নাল দৌড়ে এসে তাকে পানি খাওয়ালো!জাহিদ দুর্বল স্বরে বলল-“চাচা..তুমি এত বারবার এ ঘরে এসোনা।এ রোগ ছোঁয়াচে…কেন নিজেকে বিপদে ফেলবে বলো।একটা জগ গ্লাস রেখে চলে যাও!”
-“বাবাগো,বলছিলাম…কুমকুম মামনিকে এট্টু খবর দেই?”
-“না..চাচা..না..এ কাজ করোনা..আমার মত হতভাগা নরাধমের জন্য ঐ বেচারী অনেক কষ্ট করেছে আর কত করবে..?
-“না!না…ওকে সুখী হতে দাও!ওকে কিছু জানিওনা..এ আমার পাপের শাস্তি, যে বাবা-মা-স্ত্রীকে কাঁদিয়ে নিজের সুখ খুঁজতে গিয়েছিলাম!”বলে কেঁদে ফেলল জাহিদ।
আয়নাল ভেজা চোখে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরাগুলো তুলে চলে যেতে যেতে শুনল জাহিদ কাতরাচ্ছে-“মা..মা গো..ও..মা…!”
আয়নাল চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা!চোখ মুছতে মুছতে সিদ্ধান্ত নিলো বড় মিয়া(জাহিদের বাবা)আর জাহিদ যতই নিষেধ করুক।একটা শেষ চেষ্টা সে করবেই।এ বাড়ীর প্রতি তার অনেক ঋণ।আজ ঋণ শোধের দিন!
কুমকুমের আম্মা কুমকুমের চুল বেনী গেঁথে দিচ্ছিলেন।মেয়েটা একটুও নিজের যত্ন নেয়না।তাই আজ নিজেই চিরুনী হাতে ওকে বসিয়ে বেনী করে দিচ্ছিলেন।বাইরের উঠান থেকে আয়নাল মিয়ার সস্বর শুনে কুমকুম সচেতন হয়ে উঠল-
“মা….কে যেন ডাকছে দেখো তো !
কুমকুমের আম্মা ঊঁকি দিলেন ডাক শুনে!
-“ও..আয়নাল মিয়া তুমি….তা হঠাৎ কি মনে করে?”
-“কুমকুম আম্মার জন্য কয়েকটা ডাসা পেয়ারা আনছিলাম।ভাবলাম পেয়ারাও দিয়া যাই,একটু দেখাও কইরা যাই!”
কুমকুম মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে নিজেই বেরিয়ে আসল।আয়নাল বৃদ্ধ মানুষ।তাই কুমকুম পর্দার সাথে তার সঙ্গে দেখা করে।এতদিনতো আয়নালের সাহায্যেই শ্বশুড়ের দেখাশোনা করে এসেছে কুমকুম।
-“কেমন আছেন চাচামিয়া?
-“ভালো গো আম্মা!”বলে চারদিক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল-“আম্মাগো,জাহিদ বাবাজীর শরীর খুব খারাপ,ডাক্তাররা কইছে হের রোগ সারতো না!সারাদিন ঘরে শুইয়া মায়েরে ডাকে। হেরে মন থেইকা মাফ কইরা দিও গো মা…!”
আয়নাল চোখ মুছতে মুছতে দুত সে স্থান ত্যাগ করে।আর কুমকুম নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে উঠানেই বসে পড়ে!
-“মুমু….?”
ফারুক ডাকলো।মুমু মায়ের সাথে বসে ছুরি দিয়ে সব্জি কেটে দিচ্ছিলো!ফারুকের এমন ডাকে ও চমকে উঠল।ফারুক তার নাম ধরে এমনভাবে কখনো ডাকেনি!
মুমু আর স্থির থাকতে পারছেনা।কোল থেকে ঝুড়ি নামিয়ে পড়িমরি করে ছুটল মুমু।পেছন থেকে শ্বাশুড়ী বললেন-“আরে আস্তে যা…!”বলে তিনি মৃদু হাসলেন!প্রায় দৌড়ে এসে মুমু হাঁপাচ্ছে।দম নিয়ে বলল- -“ডেকেছেন?”
-“জ্বী…ডেকেছি…একি হাঁপাচ্ছো কেন?”
-“না..যেভাবে ডাকলেন..ভাবলাম..!”
-“আমার ডায়রী কই?”
-“আমি তো নেইনি!”
-“না নিলে কোথায় গেলো, এখানেতো নেই!”
মুমু নিজেও খুঁজল।তারপর সেল্ফের একদম উপরের তাকে দেখতে পেয়ে ফারুককে দেখালো-“ঐ তো!”
-“হমম….যাও!”
-“ব্যস্..এ জন্যই ডাকলেন?”
-“নাহ্…আদর করার জন্য ডেকেছি!”
মুমু লজ্জিত হাসল!
ফারুক একটার উপর একটা বই শব্দ করে রাখছে আর মুমুর দিকে তাকাচ্ছে।হঠাৎ বলল–“শ..খ কত?”
-“মানে?”মুমুর হাসি মুছে গেল।
-“এই যে বেহায়া মেয়েদের মতো আমার পিছনে ঘুরঘুর করো।আমার কি আর কাজ নেই তুমি ছাড়া?আদর করবো বলেছি আর অমনিই সত্যি বলে বিশ্বাস করলে?হা হা হা..!”ফারুক হেসে উঠল।
রাগে অপমানে মুমুর চোখে পানি চলে এলো।দুবার মুখ খুলল কিছু বলার জন্য।কিন্তু কথা খুঁজে না পেয়ে ফোঁস করে জ্বলে উঠে বলল-“আজ থেকে আমি আপনার হাতে ড্রেসিং করবোনা,একদম না!”
-“ইহ্….বড় ভয় দেখালে?”
-“আপনি..আপনি..একটা!”
-“কি? আমি কি?”দুহাত কোমড়ে রেখে মুমুর সামনে এসে দাঁড়ালো।মুমু কথা খুঁজতে লাগলো।
ফারুক বলে দিলো-“জানি তো বলবে..আপনি একটা দারুন লোক..আমি তো পুরা ক্রাশড….কিন্তু আমি স্যরি..আমার হাতে প্রেম করার মত ফালতু টাইম নাই!হাতে অনেক কাজ থাকে,বুঝলে?””
মুমু রাগে দুঃখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা।ফারুক ওর দিকে তাকিয়ে হাসল-“রাগ করো আর যা’ই করো!সত্য সত্যই।প্রেম ফ্রেমে আমি নাই!”
-“তাহলে আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেন?”
হঠাৎ সুর নরম করে বলল মুমু।ফারুক বই গুছিয়ে একপাশে রেখে বলল-“এই..মা জোর করলো..আমিও ভাবলাম..একটা ঝামেলা শেষ হয়..তাই..!”
মুমুর দুচোখে পানি।
ফারুক এদিকে তাকালোনা,বই নিয়ে বেরিয়ে গেল।কেবল যাবার সময় মুমুর মাথায় বই দিয়ে আলতো করে বাড়ি মেরে গেল।মুমু ওকে পেছন থেকে দেখতে লাগল।তারপর বিছানায় বসে কাঁদতে লাগলো।ফারুক তাহলে ওকে একদমই ভালোবাসেনা?
এজন্যই তো কাছে ভিড়তে দেয়না।মুমুর ভাগ্যটাই কি এমন যে কারো সত্যিকারের ভালোবাসা পাবেনা?”
জাহিদ প্রচুর কাশছে।একবার ডান কাত আরেকবার বাম কাত,কোনোভাবেই সে কাশি কমাতে পারছেনা!কাশতে কাশতেই উঠে বসল।পানির গ্লাসটা হাতড়ালো।বেড সাইড টেবিলেই তো সেটা থাকে,
নেই তো!হঠাৎ কেউ ওকে পেছন থেকে একহাতে জড়িয়ে ধরল।অপর হাতে পাণির গ্লাস মুখের সামনে ধরল।জাহিদ কাশির জন্য কথা বলতে পারছেনা তাই আগে পানিটা খেলো তারপর কাশির দমক কিছুটা কমলে বলল-“কে..কে..তুমি?আয়নাল..?
জাহিদের মন বলছে এমন নরম কোমল হাত তো আয়নালের হতে পারেনা!”
-“কথা বলছোনা কেন? কে তুমি?”
জাহিদ চোখ কচলে কয়েকবার দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু ঝাপসা একটা অবয়ব ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না।কিন্তু সে কথা বলেনা কেন?”
জাহিদ ডাকলো -“আয়নাল মিয়া?”
সামনের ঝাপসা মুর্তিটা তাকে কাত করে শুইয়ে দিলো! তারপর বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।জাহিদ ভাবল-“এ কি কোন জ্বীন পরী!কথা বললো না কেন?”
কিছুক্ষণ পর আয়নাল মিয়া ঢুকল-“ডাকছো বাবা?”
-“কে এসেছিলো ঘরে?”
-“,দেখিনাই তো বাবাজী।”
-“যেই আসুক মানা করবে,আমাকে ধরতে..এ রোগ বড় ছোঁয়াচে।কার মরার শখ হয়েছে? “বলে জাহিদ কাশতে লাগল।
কুমকুমের বাবা জাহিদের বাবার হাত ধরে বললেন-“বেয়াই সাহেব,মেয়েটা পায়ের উপর আছড়ে পড়ে যে কি কাঁদলো!
বাপ হয়ে সহ্য করতে পারলাম না।ওর কান্না দেখে ওর মা’ই বলল,দিয়ে আসেন ওরে ওর স্বামীর ঘরে।ওর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে!
ওর এমন বুক ফাটা কান্না আমি দিনরাত শুনতে পারবোনা!কুমকুমকে তাই দিয়ে গেলাম! ওকে দেখবেন! জাহিদের বাবা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না,কেবল কাঁদছেন!””
কুসুম.গরম পানির বোল এনে ঘরের ভেতর রাখলো আয়নাল।কুমকুম খাটের উপর উঠে জাহিদকে আস্তে করে উঠিয়ে বসালো!জাহিদ বলল-“আরে কে তুমি?বারবার আমাকে ধরছো কেন?”
-“কথা না বলে জামাটা খুলুন তো গা মুছবো।” কুমকুম বলল।
-“কুমকুম?ত্..তুমি কুমকুম?”
জাহিদ অস্থির বোধ করলো।ওর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।-“না..না..ধরোনা….. আমাকে..তোমারো হয়ে যাবে..!আমাকে পাপে ধরেছে।এটা বড় ছোঁয়াচে..!তুমি কেন এসেছো!”
-“আহা!কথা পরে বলেন তো,আগে জামা খুলুন।ঘরে কেউ নেই,খুলুন তো..!”
জাহিদ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে!কুমকুম নিজেই ওর জামা খুলে পাতলা নরম সুতির কাপড় দিয়ে আলতো করে ওর গা টা মুছে দিলো।তারপর কোমড় থেকে মুছা ধরতেই জাহিদ বাধা দিলো-“কি করছো?ছাড়ো,লাগবেননা!”
-“অবশ্যই,লাগবে।আপনি ছাড়ুন তো!মুছতে দিন!”
জাহিদের চোখ ভরে গেছে পানি।কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা কেবল বলল-“,কুমকুম,তোমার সেবা পাবার কোনো অধিকার আমার নেই।তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি এটা তার শাস্তি।আল্লাহ আমাকে কখনো মাফ করবেনা..!
“বলার সাথে সাথেই কুমকুম ওর ঠোঁটের উপর হাত রাখল-“ছিঃ একথা বলবেন না!আল্লাহর বড়ত্ব সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই বলেই একথা বলছেন।জানেন,
একবার বণী ঈসরাইল গোত্রের এক মহাপাপিষ্ঠ খুনী বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর ভয়ে কাতর হয়ে এক মুসলমানের কাছে গিয়ে বলল-“আমিতো সারাজীবন প্রচুর পাপ করেছি,
হেন পাপ নাই জীবনে করিনাই,আমার জন্য আল্লাহর দরবারে কি কোনো তওবা আছে?সেই লোকটি ৯৯জন লোককে হত্যা করেছিলো।পরে তাকে ঐ লোক পথ দেখিয়ে বলল,
ঐ যে মুসলমানদের গ্রাম দেখা যায়,ওখানে যাও,ওরা তোমাকে তওবা করিয়ে দেবে!বৃদ্ধ লোকটি ধীর পায়ে সেদিকে হেটে যেতে লাগলে পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়।তখনি জান্নাত আর জাহান্নামের ফেরেস্তাদের দুটো দলই তাকে নিতে এসে তর্ক জুড়ে দেয়,
এ বলে ও পাপী ও বলে না সে তওবার পথে গেছে।পরে তারা আল্লাহর কাছে আর্জি জানালে মহান আল্লাহ বলেন তোমরা পথ মেপে দেখো।কোন পথটাতে সে বেশী এগিয়েছে।
ওদিকে পথকে আল্লাহ তা’লা হুকুম দিলেন নেকীর পথকে দীর্ঘ হতে আর গুনাহের পথকে সংকীর্ণ হতে।ফেরেস্তারা মেপে দেখলো বৃদ্ধটি নেকীর পথেই বেশীদুর এগিয়েছে।তখন লোকটির রূহ জান্নাতী ফেরেস্তারা নিয়ে গেল।দেখলেন তো?
আমাদের পাপ যত বড়ই হোক,জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত হোক না কেন,তা আল্লাহর দয়া আর ক্ষমার
তুলনায় অতি নগন্য! শুধু প্রয়োজন একফোঁটা আফসোসের কান্না।সব পাপ ধুয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!নিন্,মুছাও শেষ।”
জাহিদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল-“কুমকুম এ রোগ ছোঁয়াচে,তুমি নিজেকে বিপদে ফেলোনা!”ধীরে ধীরে বলল জাহিদ,তার মুখে আর কোনো কথা জোগালো না!
কুমকুম আয়নালকে ডেকে পানির বোলটা সরাতে বলে নিজেই ঘরটা মুছে ফেলল।তারপর জাহিদকে বলল-“আমি আসছি,কেমন?”
আধাঘন্টা পর কুমকুম একটা কাঁচের বাটিতে উষ্ণ স্যুপ নিয়ে জাহিদকে খাওয়াতে বসল!জাহিদ বলল-“কি করছো তুমি!তোমাকে কি বললাম?এ রোগ ছোঁয়াচে!”
-“আপনি দুনিয়া জোড়া লেখাপড়া শিখে এসেছেন কিন্তু আসল সত্য থেকে দুরেই রয়ে গেছেন।শুনুন,ছোঁয়াচে বলে কোনো রোগ নেই,এটা রাসুল সাঃ এর কথা।
সংক্রামক ব্যাধী থাকতে পপারে,হাঁচি কাশি থেকে রোগের জীবানূ ছড়াতে পারে কিন্তু ছুলেই রোগ হয়ে যাবে এটা পুরোপুরি মিথ্যা!একবার আরবে উটের মধ্যে মড়ক দেখা দিলে সবাই বলল,
এক উট থেকে সব উটে ঐ রোগ পেয়েছে তখন রাসুল সাঃ বলেছিলেন-“তাহলে প্রথম উটটাকে কিভাবে রোগে পেলো?”হাদিসটা অনেক বড় তাই সংক্ষেপে বললাম।শুনুন,
আপনার বিজ্ঞান দিনে দশবার থিউরী বদলায় কিন্তু রাসুল সাঃ সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে যা বলে গেছিলেন তা তো আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে,তবু আপনাদের ঐ বিজ্ঞানেই বিশ্বাস!”
-“তুমি এখনো মাদ্রাসা চালাও,তাই না?”জাহিদ হঠাৎ প্রশ্ন করলো!
কুমকুম জবাব দিলো-“জ্বী,চালাই,কিভাবে বুঝলেন?”
জাহিদ ম্লান হেসে বলল-“,তোমার লেকচার শুনে।”বলে দুজনেই হেসে উঠল।আজ অনেকদিন পর বাড়ীটাতে হাসির ফোয়ারা ঝরল।জাহিদ সাথে সাথেই থেমে গেলো।
কুমকুমও চুপ হয়ে গেল,দুজনেরই বিয়ের রাতের সেই ক্ষণটির কথা মনে পড়ে গেলো যখন জাহিদ এই একই কথা বলেছিলো!
কুমকুম অবশ্য সাথে সাথেই মনমরা ভাব কাটিয়ে উঠে নিজের ওড়নার প্রান্ত দিয় জাহিদের ঠোঁট আলতো করে মুছে ওকে আধশোয়া করে বসিয়ে দিল।জাহিদ বলল-“আমার অপরাধের বোঝা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছো কুমকুম!”
-“একবারে সব শোধ করে দিয়েন, হলো তো?”
-“সেই সুযোগ কি পাবো? তুমি আমার মধ্যে বেঁচে থাকার প্রেরনা যোগাচ্ছো।ইস্..একটিবার যদি তোমার মুখখানি দেখতে পেতাম!”বোধহয় এই চোখের সেই সৌভাগ্য হবেনা!”
-“চুপ করে ঘুমান তো!”
-“,ঘুমাতে ইচ্ছে করছেনা।তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।তুমি কথা বলো আমি শুনি!”
-“একটুও না..!এখন আপনি ঔষধ খাবেন তারপর ঘুমাবেন।”
-“,ঘুম আসেনা কুমকুম।সারারাত ছটফট করি!”
-“আমি ঘুম পাড়িয়ে দেবো!আপনি একটু বসুন!আমি এগুলো রেখে আসি!”
মৃত্যুপথযাত্রী জাহিদ কুমকুমের ফেরার অপেক্ষা করছে।তৃষিত অন্তরে। যে অন্তরে নতুন করে বাঁচার লোভ জাগিয়ে দিয়েছে কুমকুম নামের মেয়েটি।..
প্রতিদিনই ফুসকুড়ি গুলো থেকে কস মতো বের হয়,আর প্রতিদিনই কুমকুম ধৈর্য্যের সাথে তা পরিস্কার করে দেয়।লোমকূপগুলোর মুখে জমাট বাঁধতে দেয়না।তারপরেও ঘা গুলো যেই কে সেই।
তবু কুমকুমের নিরলস প্রচেষ্টার অন্ত নেই!ওর সারাটা দিন কাটে জাহিদের পেছনেই।
যেদিন কুমকুম এসেছে সেদিনই ঘরে ঢুকে একটা চাপা গন্ধ টের পেয়েছে তাই প্রতিদিনই বিছানার চাদর তুলে ফেলে সে! তা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে রৌদ্রে মেলে দেয়।
কুমকুমকে ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য আয়নাল একজন ঠিকে বুয়া যোগাড় করে দিয়েছে।সে কাজের চেয়ে কথা বলে বেশী।
প্রথম দিন এসেই সে বলতে লাগল-“এই আদামড়া মানুষটারে টাইন্যা নিজের সোনার অঙ্গ ক্ষয় করতাছেন গো আম্মা! আমনের মত মাইয়া হের লেইগা এত খাটতাছে ভাবতেও বিস্ময় লাগে!”
কুমকুম রান্না করতে করতে জবাব দিয়েছে-“আপনাকে যা কাজ দিয়েছি সেটাই করেন,এসব ব্যাপারে আপনার কথা বলার দরকার নেই!”
-“না..না..আমার কি দরকার।কই তো আপনের লেইগা…..মায়া লাগে,এমন সুন্দর মানুষ আপনে আর…..এই আমারেই দেহেন না…
কি সুন্দর চেহারা আছিলো,মাইনষে একবার দেখলে দুইবার চাইয়া দেখতো আর অহন ঘাটের মড়াও ফিরা চায়না..!”
-“হমম…বুঝলাম,এখন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে কাপড়গুলো রৌদ্রে মেলে দিন।বলে জাহিদের জন্য শরবত নিয়ে গেল।জাহিদ চোখ বন্ধ করে পড়েছিল।
কুমকুম কপালে হাত রাখতেই চোখ মেলল।কুমকুমের চোখে পানি ভরে এলো।কি সুন্দর চেহারার স্বাস্থ্যবান লোকটা রোগে শোকে কি হয়ে গেছে।কুমকুম চোখের পানি লুকিয়ে মুখে হাসি টেনে জাহিদের গা ঘেষে বসলে
জাহিদ অস্বস্তিতে কুমকুমের দিকে তাকায়-“তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখিও না কুমু!আমি তোমার ছোঁয়া পাবারও যোগ্যতা রাখিনা,এতো চেষ্টা করছো কিন্তু দেখো আমার কোনো উন্নতি নেই।
লন্ডনের ডাক্তাররা আমাকে যে রিপোর্ট দিয়েছে..তা দেখে ওরা আমাকে সেদেশে রাখেনি..নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
যাকে ভালবেসে তোমার মত পবিত্র ফুলের মত মেয়েকে অগ্রাহ্য করলাম সেই চরম বিপদে ফেলে চলে গেলো আর আজ তুমি….!”
-“এসব ভাবনা ছাড়ুন তো..!কোনো ডাক্তার তার সীমার বাইরে গিয়ে তো চিকিৎসা করতে পারবেনা কিন্তু সকল ডাক্তারের যিনি মালিক তাঁর ক্ষমতা অসীম,
তাই তাঁর কাছেই আমার আকুল আবেদন জানিয়েছি।তিনি চাইলে সব পারেন।তাঁর রহমত থেকে আমি কখনোই নিরাশ নই!”
-“তবু কুমু…আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই,আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি পৃথিবীর সবচে বড় হতভাগা যে তোমার মত মেয়ের সাথে সোনার সংসার পেয়েও আজ নিজ ভুলে পথের ভিখিরী!
তোমাকে চোখে দেখার সৌভাগ্যটুকু হচ্ছেনা!তুমি মন থেকে আমাকে ক্ষমা করে দিও যেন মরেও শান্তি পাই!”
কুমকুম আড়ালে চোখ মুছে খুব সাবধানে যেন জাহিদ টের না পায়, কুমকুম ওকে মনমরা করতে চায়না।চায় ওর ভেতরকার জীবনী শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে।তাই কুমকুম ওকে বিভিন্নভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যায়।
হতাশা থেকে সরিয়ে রাখতে চায়!
কুমকুম প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল-
-“নিন্,শরবতটা খেয়ে নিন্!তারপর আপনাকে তায়াম্মুম করিয়ে দেবো,জোহরের নামাজটা আদায় করে নেবেন!”বলে গ্লাসটা জাহিদের মুখের সামনে ধরে!তারপর বলে জানেন আজ আমি কি পড়েছি?”
জাহিদ প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে তাকায়!কুমকুম বলে, বিয়েতে পাওয়া গলার চেইনটা যেটাতে আপনার নাম লেখা আছে।ছুঁয়ে দেখুন।’
জাহিদ হাত বাড়াতে গেলে অজান্তেই হাতটা কুমকুমের গায়ে ধাক্কা লেগে যায়।কোথায় লেগেছে বুঝতে পেরে জাহিদ হাতটা মুঠো করে আড়ষ্ট ভাবে দ্রুত সরিয়ে নেয়।কুমকুম নিজেও অপ্রস্তত হয়ে যায়।
তারপর দ্বিধা কাটিয়ে নিজেই জাহিদের হাতটা তুলে নিজের গলার চেইনের ওপর রাখে।জাহিদ চেইনটা তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।কুমকুমও গ্লাস নিয়ে উঠে পড়ে!
মুমু চুপ করে শুয়ে আছে।ফারুক খাতা দেখা শেষ করে দুহাতে আড়মোড়া ভেঙ্গে গ্লাসে পানি ঢালে।এর ফাঁকে ফাঁকে মুমুর দিকে তাকায়।মেয়েটা চুপচাপ হয়ে গেছে!
পানিটা খেয়ে মুখ মুছে বিছানায় গিয়ে বসে ড্রেসিং বক্সটা বের করে বলে-“কই এসো!”
মুমু সামান্য চমকে বলে-“না..থাক্..!”
-“থাকবে কেন…এসো! আর তো মাত্র এক সপ্তাহ তারপর ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাবো,দেখি উনি কি বলেন!”
মুমু চুপ করে শুয়ে রইল।চোখে পানি! ফারুক আবার ডাকল-“কি হলো,আসোনা কেন?”
-“বললাম না,দেবোনা আজকে..!”
ফারুক খানিক চুপ থেকে বলল-“এবার কিন্তু আমি আসবো..!”
মুমু ধীরে উঠে বসে বলে-“দিন্…আমারটা আমি দেবো..!”
ফারুক দেখলো ওর চোখে পানি চিকচিক করছে।সুর নরম করে বলল-“আচ্ছা,দুপুরের কথাটার জন্য স্যরি,এবার এসো,তুমি একা পারবেনা,পিঠে কি তোমার হাত যাবে?”
মুম এগিয়ে এলো!জামা সরাবার মুহূর্তে ফারুক বলে উঠল-“প্রতিদিন কি যে এক যন্ত্রনা..!”
মুমু ঝট করে নিজের কাপড় সোজা করে বলল-“আমারটা যতটুকু পারি আমিই দিবো,বললাম না!আপনার দিতে হবেনা !”
ফারুক এবার ওকে জোর করে টেনে জামা সরিয়ে পেটে,পিঠে জীবনুনাশক লিকুইড দিয়ে মুছে তারপর মলম মাখিয়ে দিল।মুমু নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।কাজ শেষ করে ফারুক হাত ধুয়ে এসে দেখলো মুমুর চোখ তখনো ভেজা।
চুপচাপ টেবিল থেকে ডায়রীটা তুলে এনে আস্তে করে মুমুর সামনে রেখে নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়লো!
কিছুক্ষণ পর মুমু উঠে বসে ডাইরীটা টেনে নিল।ফারুকের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে!
ডাইরী খুলে পড়া শুরু করল মুমু!পড়তে গিয়ে মুমুর মুখ ক্রমশ লাল হতে লাগল।একঝলক আবার ফারুককে দেখে আবার ডাইরীতে মন দিলো-
“ওকে ড্রেসিং করানোটা আমার জন্য দিনদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।প্রথম দিকে অনুভূতিটা এতো তীব্র ছিলোনা।কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম ও আমার বউ সেদিন থেকে ওকে এড়িয়ে থাকাটা এক অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছে।
মুমু কাছে আসতে চায়,ভাল্রবাসতে চায় কিন্তু আমি ওকে রাগিয়ে দুরে সরিয়ে দেই কারন ও কাছে আসলে আমি নিজের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক বিচ্ছুরন অনুভব করি।মনটা চায় ওকে….!
“.মুমু ডাইরী বন্ধ করে ফেলল।মুচকি হাসিতে ভরে গেলো মুখটা।লজ্জিত হাসিতে আবার ডাইরীটা খুলল!
“……..বোকা মেয়েটা এটাও বোঝেনা যে ওকে না ছুঁয়ে থাকাটা আমার জন্য কত কষ্টের!দুজন মানুষ পাশাপাশি থাকি অথচ….এ যেন এক সাগর জলে দাঁড়িয়ে আছি অথচ তৃষ্ণার্ত।
তবে ওকে রাগাতে মজাই লাগে।রেগে গেলে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলে তখন মন চায়….!”
(থাক্,অন্যের ডাইরী আমাদের পড়ে কাজ কি?মুমুরটা মুমুই পড়ুক!)
গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল জাহিদের।ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে।ঝাপসা অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।কেবল এতটুকু বোঝা যাচ্ছে মাটিতে কেউ উপুড় হয়ে বসে আছে।
কিছুক্ষণ শোনার পর জাহিদ বুঝলো কুমকুম তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছে আর কাঁদছে।জাহিদ সেভাবেই পড়ে রইল।
ওর চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।কুমকুম নামাজ শেষ করে জাহিদের সারা গায়ে বারবার ফু দিতে লাগল।তারপর আস্তে করে জাহিদের কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে কুরআন নিয়ে বসে গেল।
এভাবেই চলছে প্রতিটা দিন প্রতিটি রাত।
এরই মাঝে কুমকুমের বাবা মা এসে জাহিদকে দেখে গেলেন।জাহিদ তাদের কাছেও ক্ষমা চাইলেন।তারা জাহিদকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ফিরে গেলেন।
কুমকুমকে একথা বলার সাহস পাননি ওর মা যে রাশেদ বিয়ে না করেই ঢাকায় ফিরে গেছে।সে বলেছে সে নাকি কুমকুমের জন্য অপেক্ষা করবে।
কথাটা শুনে কুমকুমের মা কুমকুমকে জানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু কুমকুমের বাবা বলতে দেন নি।তিনি বলেছেন-“তোমার মেয়ের চেহারা দেখে বোঝোনা?
সে জাহিদের সেবা করে যে আনন্দ পাচ্ছে তা তুমি ওকে অন্য কিছু দিয়ে দিতে পারবেনা!ওকে অযথা এসব বলতে যেওনা!ওকে ওর ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দাও!”
প্রায় দশ মিনিট সময় নিয়ে মুমুকে দেখলেন ডাক্তার আপা!বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন।সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে হেসে বললেন!-
“ওষুধগুলো স্টপ করে দাও আর দাগগুলো মুছতে একটু সময় লাগবে।একটা লোশন দিয়ে দিচ্ছি প্রতিদিন একবার দেবে,দাগগুলো ধীরে ধীরে মিশে যাবে।তোমার তো বয়স কম,দাগ চলে যাবে! যাও তোমার স্বামীকে ডাকো!”
বাড়ী ফেরার পথে মুমুকে ওর মা আর শান্তর সাথে দেখা করিয়ে আনল।মুমুর মমা না খাইয়ে ছাড়লেন না।মুমুর শ্বাশুড়ীর জন্য কিছু খাবার বক্সে করে সাথে দিয়ে দিলেন।
রিক্সায় ফারুক মুমুকে জিজ্ঞেস করল-“ডাক্তার আপা কি বললো?”
মুমু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“এই সাবধানে থাকতে বলল।লোশ দিয়েছে সেটা নিয়মিত লাগাতে বলল!”
-“আর..?”
-“আর আবার কি..?”
-“কি মাসে? তুমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে কিনা সে ব্যপারে কি বললো?”
-“স্বাভাবিক জীবন যাপনই তো করছি,অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছি নাকি?”
ফারুক দাঁত কটমটিয়ে বলল-“এক খাটে দুজন দুদিকে মুখ দিয়ে থাকাটাকি তোমার কাছে স্বাভাবিক জীবন মনে হয়?”
মুমু বহু কষ্টে হাসি চেপে বলল-“ও..ও..এই কথা..আপা বলেছে আরো দু মাস সাবধানে থাকতে!”
-“কি..?”ঢোক গিলল ফারুক!
-“জ্বী..!”মুমু শান্ত স্বরে বলল!
-“মিথ্যা বলছো না তো?”(ফারুক সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো)মিথ্যা বলা মহাপাপ আর এটা কবীরা গুনাহ।”
মুমু চুপ করে রইল!
ফারুক কয়েকবার জিজ্ঞেস করল-“সত্যি করে বলো না!”
-“জানিনা..!”মুমু নেকাবটা টেনে মুখটা ভালো করে ঢাকল।এর আগে সে এই পোষাক পড়েনি।আজই পড়লো।খুব স্বস্তি লাগছে।নিজেকে যেন হেফাজতে লাগছে।
প্রতিদিনের মত আজো ঘুম থেকে ওঠার পর জাহিদের পোষাক বদলে চাদর বদলে দেয় কুমকুম।আজ চাদর বাদলাতে গিয়ে দেখলো চাদরে সরিষার দানার মতো অজস্র গুড়ো গুড়ো কি যেন পড়ে আছে।
কুমকুমের বুকটা ধ্বক করে উঠল।জাহিদের গা হাত পা নেড়ে চেড়ে দেখে নিশ্চিত হলো যে হ্যাঁ,এগুলো ওর ফুসকুড়ি থেকেই ঝরে পড়েছে!….
কুমকুম আনন্দের আতিশায্যে কেঁদে ফেলল প্রায়!জাহিদের হাতের উপর হাত বুলাতে লাগল কোমলভাবে আর তার হাতের ঘসায় সেখান থেকে ঘা গুলো শুকিয়ে গুড়ো হয়ে ঝরছে।
কিছু এখনো কাঁচা আছে।তারমানে জাহিদের ঘা শুকাচ্ছে।কুমকুম দ্রুত একটি শুকরানা সিজদা দিলো।
জাহিদ কুমকুমকে ডাকল-“এ্যাই,কুমু,এদিকে এসো তো!”
কুমকুম দ্রুত ওর সামনে গিয়ে বসল-“জ্বী,বলুন!”
-“আমার শরীরের টনটনে ব্যথাটা না…আজ অনেক কম প্রায় নেই বললেই চলে!”
-“আলহামদুলিল্লাহ,সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ” খুশির আবেগে কুমকুম জাহিদকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেল দুবার।তারপর কুমকুম ছুটে গেল শ্বশুড়ের কাছে!
জাহিদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
পরদিনই গাড়ী আনিয়ে জাহিদকে ঢাকার নামকরা স্কিন স্পেশালিষ্টের কাছে আনা হলো।কুমকুমকে তার মায়ের বাড়ীতে দুতিনদিনের জন্য রেখে জাহিদকে নিয়ে ওর বাবা ঢাকা এলেন!
যে কয়দিন তারা ঢাকা থাকবেন সেই কদিন কুমকুম তার বাবার বাড়ীতে থাকবে এমনটিই সিদ্ধান্ত হলো।
যাবার আগে জাহিদ কুমকুমের কপালে চুমু খেয়ে ঠিক প্রথম দিনের মত মুখে মুখ রেখে বলল -“ইনশাআল্লাহ,তোমার কাছেই ফিরবো!”!
কুমকুমও ওর বুকে মাথা রেখে বলেছে-“আমি ‘অপেক্ষা’য় থাকবো!”
মুমু আজ সুন্দর করে শাড়ী পড়েছে।একটু সেজেছেও।ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল তখনি ফারুক ঘরে ঢুকেছে।একপলক ওর দিকে তাকিয়ে খাতা নিয়ে বসে গেছে।মুমু ভেবেছিলো ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাবে,
কিছু বলবে…তা না!বেরসিকের মতো খাতাপত্র্র নিয়ে বসে গেছে!মুমু উঠে একবার খাটের কাছে গেল,আরেকবার অযথাই টেবিলের কাছ দিয়ে ঘুরে গেল।ফারুক তাকালোনা।মুমু কি ভেবে পারফিউম স্প্রে করল গায়ে,
তারপর ফারুকের সামনে গিয়ে খাতাপত্র নাড়াচাড়া করে চলে আসছিলো তখন ফারুক নাক কুঁচকে বলল-“ইস্..বাজে একটা গন্ধ পাচ্ছি,কিসের গন্ধ এটা?”
-“বাজে গন্ধ?”মুমু বজ্রাহতের মত বলল!
-“হুঁ…কেমন যেন ইঁদুর মরা টাইপ!”
মুমুর কেঁদে ফেলার দশা।যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর?রেগেমেগে বলল-“আমার গায়ের পারফিউম আপনার কাছে বাজে গন্ধ মনে হচ্ছে?”
-“ওহ্…হো,তুমি দিয়েছো..?মেয়েদের পারফিউম দেয়া গুনাহ্,তাও জানোনা?”
-“আমাকে কেউ কখনো বলে নি!”মুমু থমথমে গলায় বলল!”
-“হুঁ….তাই তো বলি…আচ্ছা শোনো,আমি কাজ করছি..তুমি এখন একটু ঐদিকে যাও..কাজ করতে দাও…কেমন?”
মুমুর চোখ চিরে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল।ফারুক খাতার দিকে চেয়ে বলল-“ভাবছি,আজ থেকে রাতে তোমাকে আম্মার সাথে দিয়ে দেবো!দুটো মাস আম্মার সাথে থাকো তারপর দেখা যাবে!”
মুমু মনে মনে অস্থির হয়ে উঠল বলার জন্য যে,আমি মিথ্যে বলেছি,আমাকে তোমার কাছ থেকে দুরে পাঠিয়ো না!কিন্তু কিছুই বলা হলোনা।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ধীরে ধীরে চুরিগুলো খুলতে লাগল! চুলগুলো হাত দিয়ে কোনোরকমে খোপা করল।তারপর কানের দুল খুলতে যাবে তখনি পেছন থেকে কেউ ওকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কোলে তুলে ফেলল।
প্রথমটায় চমকে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে ফারুকের কোলে আবিস্কার করল মুমু!তারপর প্রচন্ড অভিমানে নেমে যেতে চাইলেও পারলোনা।ফারুক ওকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে আলতো করে ওর কান ধরে বলল-
“মিথ্যা বলেছো কেন?বলিনি মিথ্যা বলা কবীরা গুনাহ?”
মুমু ওর হাত ছাড়িয়ে বলল-“মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করুন,দুমাস আমি আম্মার কাছে থাকবো!”
-“বললেই হলো? এদিকে আমার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা?”ফারুক মুমুকে চেপে ধরল।
-“আরে….কি শুরু করেছেন….আমার ড্রেসিং….!”
-“ধুত্তোর ড্রেসিঙের গুল্লি মারি!”
মুমু কিছু বলতে গেলেও পারলোনা,ফারুক ওর অধর ওষ্ঠ সদর্পে দখল করে ফেলেছে।মুমু নিজেও বেসামাল।
ফারুকের ডাকে সাড়া দিতে সেও যে উন্মুখ!
ডাক্তার জাহিদের কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন।তারপর শার্ট খুলে গায়ের গুটি গুলো দেখলেন।সেগুলো শুকিয়ে পড়া ধরেছে।তিনি আবেগে উচ্ছসিত হয়ে জাহিদকে বললেন-
“ইটস্ রিয়েলি মিরাকল,মিঃ জাহিদ।ইউ আর দদ্যা লাকিয়েষ্ট পার্সন ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড!”
তিনি জাহিদকে আই স্পেশালিষ্টের কাছে রেফার করলেন।আই স্পেশালিষ্ট জাহিদের চোখে একটা লেজার থেরাপীর পরামর্শ দিলেন।
তিনি খুবই আশাবাদী! তাঁর বিশ্বাস কয়েকটা থেরাপী দিলে জাহিদ তার চোখের কার্যক্ষমতা ফিরে পেতে পারে।একেবারে পরিস্কার না দেখলেও অনেকটা দেখতে পাবে বলেই বিশ্বাস।
এসকল কাজ শেষ করতে করতে জাহিদ আর তার বাবার প্রায় আট দশদিন লেগে গেলো!ওদিকে কুমকুম তো অস্থির।জাহিদের ফোন পেয়েই সে শ্বশুড় বাড়ী চলে এলো।
নিজ হাতে ঘরদোর সব ধুয়ে মুছে পরিস্কার করলো।কয়েক পদ রান্না করলো।
বেচারা গত কয়েকটা মাস ধরে শুধু আলুনি আর স্যুপ খেয়েই আসছে!সব কিছু গুছিয়ে নিজেও ফ্রেশ হলো!
বেছে বেছে সুন্দর শাড়ীটা পড়লো!চোখে হালকা করে কাজল দিলো।বেশী সাজতে লজ্জা করছিলো, তাছাড়া জাহিদ যদি ওকে দেখতে না পায় তাহলে সেজে লাভ কি?যাক্..চোখে না দেখুক,মানুষটা তো সুস্থ হোক!
বাবাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে আয়নালকে মালপত্র নিয়ে যেতে ডাকল।আয়নাল জিনিসপত্র রেখে অভ্যেসবশতঃ জাহিদকে ধরে ঘরে নিয়ে বসালো।জাহিদ এখন চোখে বেশ ভালই দেখতে পায়।
শরীরের ক্ষতগুলোও অধিকাংশই শুকিয়ে গেছে।বলতে গেলে সে এখন অনেকটা ঝরঝরে।
জাহিদের চেহারার আগের সৌন্দরয্যটা অনেকখানিই ফিরে এসেছে।জাহিদ এবার ইচ্ছে করেই দাড়ীটা শেভ করেনি।দাড়ীতে ওকে আরো ম্যানলি দেখাচ্ছে!
জাহিদ নিজের রুমে বসে চুপ করে ডাক্তারের কাগজগুলো দেখছিলো!
কুমকুম ওদের আসার সংবাদ পেয়ে,রান্নাঘরের চুলা ধিমে আঁচে দিয়ে বুয়াকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে দ্রুত ঘরে চলে এলো।
কুমকুম ঘরে ঢোকা মাত্রই জাহিদ চোখ তুলে তাকালো।কুমকুম দরোজার সামনেই দাঁড়িয়ে গেল।জাহিদের চাহনীই বলে দিচ্ছে ও দেখতে পাচ্ছে!কেন কে জানে কুমকুমকে হঠাৎ লজ্জা ঘিরে ধরল।
মৃদু স্বরে সালাম দিয়ে দরোজার কাছেই দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে রইল।জাহিদ তৃষিত নয়নে তাকিয়ে আছে কুমকুমের দিকে।ফ্যানের বাতাসে হাতের কাগজগুলো উড়তে শুরু করেছে সেদিকে জাহিদের খেয়াল নেই।
কুমকুমকে দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সে,তারপর ডান হাত বাড়িয়ে বলল-“কুমকুম তুমি কোথায়?”
কুমকুমের মুখে অন্ধকার ছায়া ঘনাল।জাহিদ এখনো দেখতে পায়না?ও তো ভেবেছিলো!”
কুমকুম ছুটে এসে জাহিদকে জড়িয়ে ধরে ওকে দাঁড় করাল।জাহিদও অসহায়ের মত দাঁড়াল।কুমকুম ওর চেহারায় গায়ে হাত বুলিয়ে বলল-“আল্লাহর রহমতে আপনার হাতপায়ের ক্ষতগুলি নেই বললেই চলে..!ডাক্তার কি বললো!?”
জাহিদ কোন কথা বলছেনা,কেবল দুচোখ ভরে কুমকুমকে দেখছে।কি মায়াকাড়া চেহারা।চোখের কাজলটা তো জাহিদের বুকের ভেতর ঘাই মারছে যেন।জাহিদ আলতো ভাবে কুমকুমকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল,
কুমকুম সরে যেতে চেয়ে বলল-“আসেন,জামাটা চেঞ্জ করে দেই।বলে শার্টটা খুলে ঘরোয়া একটা ঢোলা গেঞ্জী হাতে নিতেই দেখলো জাহিদ অনায়াসে ওকে পাশ কাটিয়ে হেটে গিয়ে দরজাটা আটকে দিলো!
কুমকুম বিস্ময়ে হতবাক হলো-“আপনি দেখতে পাচ্ছেন?”
-“হমম!”বলে কুমকুমকে জড়িয়ে ধরে বলল-“কই,যাবার আগে যেভাবে আদর করে দিলে,এখনো তেমন আদর করো!”
-“ই..ইয়ে চুলায় রান্না!”কুমকুম মৃদু স্বরে বলল!
-“বুয়া আছে,সে দেখবে!”জাহিদ ভারী শব্দে বলল!
-“আব্বাকে ভাত দিতে হবে যে..!”
-“বুয়া আছে,আয়নাল আছে..!”
-“আপনার গরম পানি…!”‘
-“এখন লাগবেনা!”
-“ছাড়ুন,আব্বা কি ভাববে?”
-“যা ভাবার ভাবুক,কিছু করার নেই!”
-“প্লিজ…বোঝার চেষ্টা করুন!”
-“সেই ক্ষমতা তুমিই কেড়ে নিয়েছো!”
-“আরেহ্……..!”
জাহিদ তার সমগ্র জীবনে যে সুখের অস্তিত্ব
সম্পর্কে বেখবর ছিলো আজ সেই সুখের সাগরে সে ডুব সাঁতারু।
কুমকুমের ভালোবাসা আর যত্নে জাহিদের জীবন মরুভূমিতে ফুল ফুটেছে!আর সে ফুল বাগানের মালি হলো কুমকুম।
জাহিদ খুঁজে পেয়েছে জীবনের সত্যিকারের আনন্দ।
প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ শেষে কুমকুমকে নিয়ে হাঁটতে বেরোয়।হেঁটে এসে দুজনে হালকা নাস্তা সেরে জাহিদ চলে যায় ব্যবসায়িক কাজে।আর কুমকুম গিয়ে ঢোকে মাদ্রাসায়।
জাহিদের আব্বার অসুস্থতার পর থেকে জাহিদ
পুরোপুরিভাবে পারিবারিক ব্যবসাটা সামলাচ্ছে!পাশাপাশি প্রিয়তমা স্ত্রী কুমকুমের মাদ্রাসার প্রশাসনিক দিকগুলোও সে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে চলছে।
কুমকুমেরই প্রবল উৎসাহে জাহিদ নিজেও বিশুদ্ধভাবে কুরআন শিক্ষা করে নিয়েছে।
এখন রাতে শোবার আগে প্রতিদিন আধাপাতা করে কুরআন মুখস্তের কাজ চলছে।বলতে গেলে পুরো সন্ধ্যেটাই কুমকুমের সাথে কুরআন আর হাদিসের আলোচনায় কাটে।
এতে যে কি অপার আনন্দ রয়েছে তা জাহিদ আগে বুঝতে পারেনি।দুনিয়াবী আনন্দতো রয়েছেই,পাশাপাশি আখিরাতের ঘর নির্মানের কাজও চলছে জোরেশোরে।
জাহিদ কুমকুমকে কেবল দুনিয়াতেই ৫০ বা ৬০ বছরের জন্যে নয় বরং চিরযৌবনের দেশ জান্নাতেও চিরসঙ্গী হিসেবে চায়!তাই
জাহিদের ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছে আমূল পরিবর্তন।সে এখন একজন পুরোদস্তর প্রাকটিসিং মুসলিম।তার সারাজীবনের অর্জিত মেধা পান্ডিত্য দিয়ে সে ঢেলে সাজিয়েছে এই ইসলামিক বিদ্যালয়টি।
সিলেট শহরের উপকন্ঠে তাদের মাদ্রাসাটি শহরের নামকরা মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে।দুরদুরান্ত থেকে ছাত্র ছাত্রী এসে এতে ভর্তি হচ্ছে,দ্বীনের বিশুদ্ধ পাঠ নিতে!
এর মধ্যেও জাহিদের সুখের আকাশের এক কোণে দেখা দিলো কালো মেঘের ঘনঘটা!
বাবা অসুস্থতার কারনে গত বছর থেকেই তার ব্যবসাটি জাহিদই সমান দক্ষতার সাথেই চালিয়ে আসছে।ব্যবসার প্রযোজনে ওকে মাঝেমধ্যে ঢাকাও যেতে হয়।
তেমনি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক ব্যবসায়িক জটিলতা প্রকট আকার ধারন করায় জাহিদকে আজও জরুরী ভিত্তিতে ঢাকা আসতে হলো।
তার বাবার ব্যবসায়িক জটিলতার আইনগত দিকগুলো এতদিন বাবার পুরোনো পরিচিত আইনজীবি ব্যারিস্টার হাসিবুল ইসলামই দেখে এসেছেন,তিনি মারা যাওয়ায় বর্তমানে তার সহকর্মী ব্যারিষ্টার সামিয়া জামান এগুলো দেখাশোনা করছেন।
হঠাৎ বিশেষ প্রয়োজনে তিনি নিজেই জাহিদকে তার সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন,নতুবা জাহিদদের ফ্যাক্টরীতে ইনজাংশন জারী করা হয়ে যেতে পারে!আর এটা ঠেকাতে না পারলে জাহিদদের ফ্যাক্টরী বন্ধও হয়ে যেতে পারে!
প্রায় কোটি টাকার লস্ গুনতে হবে জাহিদদেরকে।বলা যেতে পারে তারা পথের ফকির হয়ে যাবে!জাহিদ তাই জরুরী ভিত্তিতে ঢাকায় রওনা দিয়েছে।
জাহিদের ইচ্ছে আছে কাজটা সেরে কুমকুমের জন্য কিছু কেনাকাটার জন্য শপিং কমপ্লেক্সগুলোতেও একবার ঢুঁ মারবে।
তবে তার আগে ব্যারিষ্টার সামিয়া জামানের সাথে দেখা করার কাজটা সারতে হবে!নামটা শুনে জাহিদের মনে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করছিলো কারন মেঘার নামও ছিল সামিয়া।
জাহিদ নিজেও জানতো না যে,ওর জন্য এতবড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো!
চেম্বারে ঢুকতেই ও মুখোমুখি হলো মেঘার।জাহিদ নিজের জায়গাতেই স্থির হয়ে গেল।মেঘা ফোনে কথা বলছিল,জাহিদকে দেখে হা হয়ে গেল,তারপর ফোনটা দ্রুত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো-“জাহিদ,তুমি?”
জাহিদ সামান্য হাসল-“কি ভেবেছিলে…. মরে গেছি?”বলে জাহিদ চলে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়ালে পেছন থেকে মেঘা ডাকল-
-“জাহিদ,প্লিজ,একটু শোনো!”
জাহিদ থমকে দাঁড়াল।
মেঘা জাহিদকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগল আর বলে চলল-“তুমি তো সেই আগের মতো হয়ে গেছো…কি আশ্চর্য্য?জাহিদ এর কোনো জবাব দিলোনা।মেঘা কাতর ম্বরে বলল-
-“জাহিদ,আমি জানি আমি অনেক বড় একটা অন্যায় করেছি।আমি তোমাকে এতদিন ধরে অনেক খুঁজেছি বিশ্বাস করো!তোমার গ্রামের ঠিকানায় তোমার কাছে যেতে চেয়েছি…!”
-“কেন?”জাহিদ গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল!
-“তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে!”
-“কিসের ক্ষমা?”
-“জাহিদ,আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো।কিন্তু আমি তো মানুষ,সেই পরিস্থিতিতে আমি একটা ভুল করে ফেলেছি।তার জন্যে ভুগেছিও অনেক।আজ আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই,প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো!”
-“আমার সাথে তোমার এখন আর কোনো সম্পর্ক নেই মিস্ সামিয়া জামান নাকি মিসেস বলবো?
-“আমি আর বিয়ে করিনি জাহিদ!”
-“ভালো..!”
-“জানি তোমার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক,কিন্তু বিশ্বাস করো,তোমাকে ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে একটি দিনের জন্যেও শান্তি পাইনি আমি..!”
-“কারো কারো কাছে শান্তি কখনোই ধরা দেয়না এর কারন হলো তাদের ভেতরকার আগ্রাসী মনোভাব।তারা কোনোকিছুতেই তৃপ্ত হয়না!”
-“বলো,যা ইচ্ছে বলো তবু আমাকে ক্ষমা করো,প্লিজ!”
-“আমার মনে হয় আমি এখানে একটা কাজের জন্য এসেছি,আর এখন আমি আমার কাজটা তোমাকে দিয়ে করাতে আগ্রহী নই! আমার ফাইলটা ফেরত দিয়ে দিলে খুশী হবো!”
-“পাগলামী করোনা জাহিদ,তোমার ফ্যাক্টরী এখন বিপদের মুখে, এসময় তুমি হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারোনা!”
-“সেটা আমার ব্যাপার..!”
-“জাহিদ..আমার কথা শোনো…!”
-“তুমি যে জাহিদকে চিনতেন,সেই জাহিদ মরে গেছে।আমি বিনা প্রয়োজনে পরনারীর সাথে কথা বলতে পছন্দ করিনা!”
-“আজ আমি তোমার জন্য পরনারী হয়ে গেলাম?”
-“অবশ্যই….এভাবে আমাকে বিরক্ত না করলেই খুশী হবো!”
-“তুমি আমাকে ইগনোর করতে কিভাবে পারছো?তুমি না একসময় আমাকে ভালোবাসতে?আমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারতেনা,আজ…….জাহিদ,দাঁড়াও…..এক মিনিট…জাহিদ প্লিজ….আমি খুবই অনুতপ্ত….আমি আজ ভীষণ একা।
জাহিদ চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মেঘা অসহায়ের মত ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল-“আমার ছোট্ট ভুলের জন্য আমাকে এতবড় শাস্তি তুমি দিতে পারোনা জাহিদ,তোমার পিছু আমি ছাড়বোনা,তোমার ক্ষমা আমি আদায় করেই ছাড়বো!”মেঘা ফোন তুলল!
পরদিন জাহিদ মেঘার এসিসট্যান্ট কে ফোন করে জানাল সে এখানে তার মামলা রাখতে চায়না।তার ফাইল তাকে বুঝিয়ে দেয়া হোক।এসিসট্যান্ট জানালো সে ম্যডামের সাথে কথা বলে জানাবে!
ঘন্টাখানেক পরেই মেঘা ফোন দিলো জাহিদকে-“জাহিদ,একটু দেখা করতে পারবে?জরুরী দরকার ছিলো!”
-“প্রয়োজন মনে করছিনা!”জাহিদ জবাব দিলো!
-“তুমি আমার সাথে এমন করতে পারছো?মানলাম আমি একটা ভুল করেছি কিন্তু আমি একসময় তোমার স্ত্রী ছিলাম,আমাদের সম্পর্ক…..”জাহিদ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল-“আমার স্ত্রী শুধু কুমকুম,
আর কেউ নয়।একজীবনের করা ভুলের সাজা আমি পেয়েছি,এখন কুমকুমই আমার জীবন,সেই আমার মরন!”
-“,কুমকুম?তোমার সেই গ্রামের বউ?”
-“হ্যাঁ,কেন,তুমি কি ভেবেছিলে,তোমার মত সেও আমাকে ফেলে চলে গেছে?আচ্ছা,আমি রাখি,আমার ফাইল রেডি রেখো,কাল এসে নিয়ে যাবো!”
বলে জাহিদ ফোন রেখে দিলো!
পরদিন চেম্বারে গেলে মেঘা হাসিমুখে জাহিদকে ওয়েলকাম করল।জাহিদ শান্ত গম্ভীর স্বরে বলল-“আমার ফাইলটা দাও….!”
-“তাহলে তুমি আমাকে দিয়ে কাজটা করাতে চাচ্ছোনা?”
-“না!”
মেঘা সামান্য হাসল।তারপর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জাহিদের সামনে এসে বলল-
“কাজটা কিন্তু বিগত দশ বছর ধরে আমাদের এসোসিয়েটস এর পক্ষ থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে।এবং এটার পিটিশনার হলেন তোমার বাবা মিনহাজুল ইসলাম।সো..
তোমাকে ফাইল ফেরত দেবার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা!আমি সরাসরি ওনার সঙ্গেই কথা বলবো,ওনাকে জানাতে চাই যে,
আমি তার এক্স বৌমা মিসেস সামিয়া জামান তার ব্যবসায়িক আইনগত দিকগুলো পরিচালনা করে আসছি আর তার পুত্র তাঁকে না জানিয়ে একসময় আমাকে বিয়ে করে বিদেশ পাড়ি জমায়…..!”
জাহিদ হতভম্ব হয়ে ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলল-“তুমি আমার বাবাকে এসব কিচ্ছু বলবেনা,তিনি খুব অসুস্থ,তাকে এসব বলে তুমি কি করতে চাচ্ছো?”
-“তোমার স্ত্রী’কেও বলবো..!”
-“তুমি কি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাচ্ছো?আমার স্ত্রী এসবই জানে!”জাহিদ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল!
-“কাম ডাউন,জাহিদ।তোমার স্ত্রী হয়ত জানে,তোমার বাবা তো আর জানেনা! তুমি আমার ভালোবাসা,আমরা দীর্ঘ ছয় সাতবছর পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম,
হ্যাঁ,মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু ওরকম পরিস্থিতিতে যে কেউ এমন ভুল করতে পারে!তাই বলে তুমি…!”
-“দেখো…আমি কাল চলে যাবো,তুমি আমার ফাইল আজই দিয়ে দেবে কিনা বলো….!”
-“যদি না দেই..?”
-“মানে? তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?”
-“ওহ্..নো..শুধু তোমাকে অনুরোধ করছি জাহিদ! প্লিজ…আমাকে ক্ষমা করে দাও..!”
-“করেছি। আর কিছু..?”
মেঘা জাহিদের কাছে এসে দাঁড়াল-“দাঁড়ীতে তোমাকে দারুন দেখাচ্ছে!তুমিতো আরো…..”
-“জাহিদ মুখ ঘুরিয়ে বাইলে তাকালো!মেঘা থেমে গেল!
মেঘা বলল-“আমরা কি আবার এক হতে পারিনা জাহিদ?”বলে জাহিদের হাত ছুঁতে যাবার আগেই জাহিদ ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে সেখান থেকে চলে এলো!
হোটেলে ফিরেও শান্তিতে ঘুমাতো পারলোনা জাহিদ।এক অস্থিরতা ওকে ঘুমাতে দিচ্ছেনা।মেঘা তার জীবনের ব্যর্থতার কষ্ট জাহিদকে দিয়ে ভুলতে চাচ্ছে।জাহিদ ভয় পাচ্ছে বাবার কানে গেলে তিনি নতুন করে আঘাত পাবেন,
তাঁর যা শারিরীক অবস্থা।এসব চাপ সহ্য করার মত মানসিক অবস্থা তার নেই!তিনি এটা শুনে যদি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যান বা আরো ক্ষতিকর কিছু ঘটে,
তাহলে জাহিদ নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেনা!তাছাড়া জাহিদ কুমকুমের মনে আর কোনো কষ্ট দিতে চায়না!
জাহিদ ভেবে পাচ্ছেনা,কি করবে!”
সে রাতেই ছিলো জাহিদের ফ্লাইট।জাহিদ সেই রাতেই ঢাকা ছাড়ল মেঘাকে কোনো কিছু না জানিয়েই!তার আগে বাবাকে পুরো বিষয়টি অন্যভাবে ধীরে ধীরে সহনশীল ভাবে জানাতে হবে।
তা নাহলে মেঘার উল্টোপাল্টা আচমকা খবরে তার হার্ট এটাক হতে কতক্ষণ!
কুমকুম রান্নাঘরে কিছু একটা করছিলো হঠাৎ পেছন থেকে জাহিদ এসে জড়িয়ে ধরল-“আসসালামুআলাইকুম,জান্..!”
কুমকুম প্রথমে চমকে গেলো তারপর হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলল-“কখন এলেন,টের পাইনিতো?”
-“টের পাননি কারন আপনি নিজ ভাবনায় মশগুল ছিলেন!তা আপনার ভাবনায় কি এই অধম ছিলো?”
কুমকুম হেসে বলল-“আমার ভাবনায় আপনি সবসময়ই আছেন…চলুন,ঘরে চলুন!”
জাহিদ চট করে কুমকুমের গালে চুমু খেয়ে বলল-“চলো!”
জাহিদ কুমকুমের উরুর উপর মাথা রেখে শুয়েছিলো!কিন্তু ওকে অন্যমনস্ক দেখে কুমকুম বলল-“আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“একটা গুনাহ মানুষকে কত ভোগান্তিতেই না ফেলে..!”
-“কি হয়েছে, ঠিক করে বলুন তো!কুমকুম বলল!
জাহিদ কিছুক্ষণ ভেবে ধীরে ধীরে মেঘার প্রতিটি কথা কুমকুমকে খুলে বলল।কুমকুম নিরবে তা শুনলো!তারপর বলল-“এখন তাহলে কি করবেন?”
-“লস্ হয় হোক,তাকে দিয়ে মামলা চালানোর প্রশ্নই উঠেনা!”
কুমকুম কোনো কথা বললোনা।ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল!
তার দুদিন পরেই জাহিদ নাস্তা খেয়ে বাইরে চলে যাবার পরই কুমকুম প্রতিদিনের মত মাদ্রাসায় চলে আসে।তখন মাদ্রাসার এক শিক্ষিকা এসে জানায় এক মহিলা কুমকুমের সাথে দেখা করতে চায়।কুমকুম ভেবেছে ভর্তি সংক্রান্ত কিছু হবে।
সে মহিলাটিকে ভেতরে ডেকে পাঠায়!মহিলাটি এসে কুমকুমের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে।কুমকুম তাকে সাদরে অভ্যার্থনা জানায়!মহিলাটি নিজের পরিচয় দিয়ে বলে-“আমি জাহিদের বন্ধু ‘মেঘা’!
কুমকুম মনে মনে চমকে উঠল,এই সেই মেঘা..?”কিন্তু মুখে কিছু বললনা।মেঘা বলে চলল-“আমার একটা ভুলের কারনে ওর সাথে আমার বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি,আমি ওকে এখনো ভালোবাসি।
আমি ওর সাথে কথা বলে নিজের অবস্থাটা ব্যক্ত করতে চাই যে ওর অবর্তমানে আমার দিন কতটা খারাপ কেটেছে…!”
কুমকুম কিছুক্ষণ নিরব রইল।
-“দেখুন,আপনি ধার্মিক মানুষ,শুনেছি আপনার মমনটাও অনেক বড়!কেউ ভুল বুঝে ক্ষমা চাইলে তাকে তো ক্ষমা করা উচিত,তা কিনা বলুন?”
-“দেখুন,এখানে আমার তো কিছু করার নেই!”
-“অবশ্যই আছে,জাহিদ একটা বিপদে পড়তে যাচ্ছে।ওর ফ্যাক্টরী ডুবলে ও ডুববে।সেটা কি আপনি চান?”
-“আপনি কি চাচ্ছেন?”
-“আমি চাই আপনি আমাকে আপনার পরিবারের অংশ করে নিন।জাহিদের ফ্যাকাটরীতে আঁচও আসতে দেবোনা!”
-“এটা কো এক ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং হয়ে গেলো!”
-“হলে হলো,জাহিদকে হারিয়ে আমি অনেক ভুগেছি,আজ আমি যখন ভুল বুঝে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি।সে কেন আমাকে আপন করে নেবেনা,বলুন?”
-“এটা তো….জাহিদই ভালো বলতে পারবে..!”
-“জাহিদ আমাকে ভালোবাসে….এটা প্রমাণিত,আমি ওকে ছেড়ে গেছি বলে ও বাধ্য হয়ে আপনার সাথে সংসার করছে,কিন্তু ভালো ও আমাকেই বাসে।এটা ওর জেদ যে ও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে..!”
কুমকুম কিছুক্ষণ নিরব থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
-“বোন্,আপনি ভাববেন না,আপনার কথা আমি ওর সাথে আলাপ করবো তবে এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলা ঠিক হবেনা!আপনি কোথায় উঠেছেন?”
-“আমি হিলটনে উঠেছি,আপনি কাইন্ডলি জাহিদকে আমার সাথে অন্তত কথা বলতে রাজী করান!আমি নিশ্চিত ও আমার সব কথা শুনলে আমাকে ক্ষমা না করে পারবেনা!”
-“কোনো স্ত্রী’র কি উচিত তার স্বামীকে পরনারীর সাথে আলাপে বাধ্য করা?”
-“উচিত না,কিন্তু আপনি তো অন্যরকম তা এখানে এসেই জানলাম।আপনি একজন মেয়ে হয়ে আমার অন্তরটা বোঝার চেষ্টা করুন!কুমকুম চুপ হয়ে গেলো।
রাতে কুমকুমকে নিরব দেখে জাহিদ বিভিন্নভাবে ওকে হাসানোর চেষ্টা করল।ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিলো।তারপর কানের লতিতে আলতো কামড় দিয়ে বলল-“আমার জানটা আজকে নিরব কেন?কোনো সাড়া পাচ্ছিনা?”
কুমকুম জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল-“আজ মাদ্রাসায় মেঘা এসেছিলো!”জাহিদ থমকে গেলো!
ওর হাতের বাধন আলগা হয়ে গেল।কুমকুমকে ছেড়ে দিয়ে বলল-“কি বলেছে সে তোমাকে?”
কুমকুম মুখ নিচু করে মেঘার বলা সব কথাই বলল।জাহিদ গম্ভীর হয়ে গেল।কুমকুম ওর কাঁধে হাত রেখে বলল-“আপনি ওকে ক্ষমা করে দিন।সে হয়ত নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে!”
-“দিলাম….তারপর?সে তো ক্ষমাতেই সন্তষ্ট না!সে বলেনি সে কি চায়..?”
কুমকুম মাথা নাড়ল-“আপনার সঙ্গী হতে চায়!”
-“এটা জেনেও তুমি আমাকে তার সাথে কথা বলতে বলছো?”
-“জাহিদ,আপনার ফ্যাক্টরী নিলামে উঠবে,তাছাড়া বাবা এই আঘাত সহ্য কেতে পারবেন না।সব দিক দিয়ে এই পরিবারের বিপর্যয় নেমে আসবে…কেবল আপনাকে নিজের করে ধরে রাখতে গিয়ে এতবড় ক্ষতি কিভাবে হতে দিতে পারি আমি?”
-“তাই বলে তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় তার হাতে তুলে দেবে?”জাহিদ রেগে গেলো!
কুমকুমের চোখে পানি দেখা গেল!
জাহিদ দুহাতে ওর মুখখানি তুলে ধরে বলল-“আমাকে তুমি বিশ্বাস করো?আমি যে ওকে বিন্দুমাত্র ভালোবাসিনা এটা বিশ্বাস করো? নাকি তোমার মনে সন্দেহ আছে?””
কুমকুম কিছু বললো না।
জাহিদ ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল-“ও উল্টাপাল্টা যা ইচ্ছে বলে গেলো আর তুমি সেটাই ঠিক ধরে বসে আছো?”
কুমকুম আস্তে করে বলল-“জাহিদ…আ..আপনিতো চাইলে ওকে বিয়ে করতে পারেন!”
জাহিদ কুমকুমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল-“থাপ্পড় চেনো?”
কুমকুম মুখ নিচু করল।
জাহিদ বলল-“অন্য কেউ বললে তাকে চড়ই মেরে বসতাম।কি করে পারলে একথা বলতে?কেমন মেয়ে তুমি…?
কুমকুম কিছু বলতে চাইলে জাহিদ বাধা দিয়ে বলল-“আমার জীবনে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন নারীর স্থান নেই!এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে চাইনা!”
বলে জাহিদ বিছানা থেকে নেমে বাইরে চলে গেলো!
ফারুক নিজের প্রানান্তকর চেষ্টায় একটা ছোটখাট কিন্ডারগার্টেন চালু করেছে।
বেশ ভালই চলছে স্কুলটা।ফারুক এখন এটির উন্নতি নিয়ে মহাব্যস্ত।স্কুল বন্ধ থাকলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মুমুকে নিয়ে চিটাগং কক্সবাজার ঘুরে বেড়ায় ও।
এ বছরও যাবার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু মুমু নিষেধ করেছে এবছর সে যেতে পারবেনা।ফারুক জানতে চাইলো-“কেন,কি সমস্যা?”
মুমু ফারুকের হাতে একটা ছোট্ট চিঠি গুঁজে দিয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকেছে।ফারুক অবাক হয়ে চিঠি খুলে খুশিতে মুমুকে শূন্যে তুলে ফেলল।মুমু ভয়ে ফারুককে আঁকড়ে ধরে বলল-“আরে পড়ে যাবো,তো..নামান প্লিজ!”
ফারুক ওর কানের কাছে মুখ রেখে বলল-“সত্যি,আমি বাবা হবো?”
মুমু ফারুকের বুকে মুখ গুঁজে বলল-“হমম…!”
ফারুক পরমানন্দে মুমুকে জড়িয়ে ধরল।
জাহিদ অফিসে বসেই মেঘাকে ফোন দিল।জাহিদের নাম্বার দেখে মেঘা দ্রুত ফোন তুলল।জাহিদ শান্ত স্বরে বলল-“তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি,একটু আসবে?”
-“এখনি আসছি!তুমি কোথায়?”
-“তোমার হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে অপেক্ষা করছি!”
আধাঘন্টার মধ্যেই মেঘা সুন্দর করে সেজে নিচে এলো।জাহিদ গাড়ীর দরোজা খুলে দিলে মেঘা তাতে উঠে বসার আগে বলল-“আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”
জাহিদ হাসল-“খুব ভালো..!”
মেঘা জাহিদের দিকে তাকিয়ে হাসল,তারপর গাড়ীতে উঠে বসল।গাড়ী স্টার্ট দেবার আগে জাহিদ বলল-“গতকাল কুমকুম আমাকে অনেকক্ষণ তোমার ব্যপারে বুঝিয়েছে,ভেবে দেখলাম ওর কথাটাও ঠিক।
তোমার আমার একসময় গভীর বন্ধুত্ব ছিলো সেটারও তো একটা মূল্য আছে।তাছাড়া তুমি তো আমাকে অনেক ভালোবাসো,তাইনা?”
মেঘা জাহিদের স্টিয়ারিং ধরা হাতের উপর হাত রেখে বলল-“বিশ্বাস করো,তোমাকে ছেড়ে আসার পর থেকে একটি দিনের জন্যেও শান্তি পাইনি,বিয়ে কি কেতে পারতাম না?কিন্তু মন থেকেই আসেনি!পরে বুঝলাম তোমাকে ভালোবাসি বলেই….!”
জাহিদ গাড়ী ষ্টার্ট দিলো।গাড়ী সামনের দিকে টান দিয়ে বলল-“তোমাকে নিয়ে আজ দুরে হারিয়ে যাবো….রাজী আছো?”
মেঘা দুহাত আনন্দে চাপল-“ইউনিক….লং ড্রাইভে যাবে..?ওয়াও…জাহিদ তুমি আমাকে সারপ্রাইজড করলে,আমি জানি তোমার মনে আমার ভালোবাসা মুছে যেতে পারেনা!”কুমকুম” এসে সেটাকে আড়াল করেছে মাত্র!”
কুমকুমের নাম শুনে জাহিদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।জাহিদ এক্সিলেটরের উপর চাপ বাড়াল।
স্পিডোমিটারের কাঁটা কাঁপতে কাঁপতে বিশ…ত্রিশ…..চল্লিশ….. পঞ্চাশ…..ষাট…করে সত্তর ছাড়াতে দেখে মেঘা ঘাবড়ে গেল-
-“জাহিদ…কি করছো…স্পিড কমাও!”
জাহিদ শান্ত স্বরে বলল-“ঘাবড়িও না…..মরলে আজ দুজনে একসাথেই মরবো…কারন তুমি আমাকে এমনিতেও বাঁচতে দেবেনা!”
মেঘা আঁতকে উঠল-“এসব কি বলছো তুমি..পাগল হলে?স্পিড কমাও প্লিজ..!”
-“স্পিড কমানো যাবেনা,আর গাড়ীতে ব্রেক নেই…চলো প্রিয়তমা দুজনে এবার একসাথে মরি।
-“জাহিদ,এসব কি বলছো?”
-“কেন?তুমি তো আমাকে অনেক ভালোবাসো তাই না?”
মেঘা ছটফট করে উঠল।
চিৎকার দিয়ে স্টিয়ারিং ধরতে চাইল।
জাহিদ গোঁয়ারের মত স্পিড বাড়িয়েই চলছে…পঁচাত্তর….আশি…..!”
মেঘা পাগলের মত চিৎকার করে উঠল-“জাহিদ…..থামাও….
থামাও বলছি…প্লিজ…দোহাই লাগে……জাহিদ……মরতে হয় তুমি মরো…আমি কেন তোমার সাথে মরতে যাবো…থামাও প্লিজ….প্লিজ….! জাহিদ…..আল্লাহর কসম লাগে….আ..আ…..!”
তীব্র স্বরে স্কিড করে গাড়ীটা রাস্তার একপাশে থামল!
মেঘা প্রচন্ড ঝাঁকিতে সামনে ঝুঁকে গাড়ীর ড্যাশবোর্ডের সাথে মৃদু ধাক্কা খেলো!ওর কপালটা সামান্য ঠুঁকে গেলো!
গাড়ী থামার সাথে সাথে হাঁপাতে হাঁপাতে ও দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে গিয়ে বলল-“তোমার মত গোঁয়ারের সাথে আর এক মুহূর্ত না।জাহান্নামে যাও তুমি…….স্কাউন্ড্রেল!”
বলে মেঘা হাঁটা ধরল।
জাহিদ কপালের ঘাম মুছে স্টিয়ারিঙের উপর দুহাত রেখে তাতে মাথাটা ঠেকিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইল,শোকর জানালো!
প্রায় আধা বিধ্বস্ত অবস্থায় জাহিদ বাসায় ফিরল।কুমকুম উদ্বিগ্ন হয়ে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল।জাহিদ ঘরে ঢুকতেই কুমকুম ছুটে গিয়ে ওকে ধরল-“আমার উপর রাগ করে কাল থেকে একটা কথাও বলেননি,সকালেও নাস্তা না খেয়েই চলে গেলেন….
আমি যদি অন্যায় করে থাকি শাস্তি দিন,কিন্তু এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন?”
জাহিদ ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল-“নিজেকে শাস্তি দিতেই গিয়েছিলাম,তোমার জন্য পারলাম না!”
-“এসব কি বলছেন আপনি..!আচ্ছা,আমার ভুল হয়েছে…আমাকে ক্ষমা করুন,প্লিজ!”
কুমকুম জাহিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।জাহিদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা!কুমকুমের মুখের কাছে মুখ এনে বলল-“আর যদি কোনদিন আমাকে তোমার কাছ থেকে দুরে ঠেলে দাও তো…..কুমকুম ওর কথা শেষ করতে দিলোনা,চুমু দিয়ে ওর মুখটা বন্ধ করে দিয়ে বললো-“আর হবেনা এমন,প্রমিজ!”
জাহিদ ওকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল।কুমকুম সরে যেতে চাইল-“কি করছেন,গেট খোলা!”
জাহিদ ওকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে পা দিয়ে সশব্দে গেটটা আটকে দিলো!”
পরদিন মেঘা জাহিদের ফাইল সহ সমস্ত কাগজপত্র ফেরত দিলো!আয়নাল এসে তা জাহিদের কাছে দিয়ে গেলে জাহিদ মুচকি হেসে ফাইরটা দিয়ে কুমকুমের মাথায় মৃদু চাঁটি মেরে বলল-“এই হলো ভালোবাসা…বুঝেছো?”
কুমকুম হেসে উঠে দাঁড়ালে জাহিদ হ্যাচকা টানে ওকে নিজের বুকের উপর এনে ফেলল-“কাল কিন্তু তুমি প্রমিজ করেছিলে!”
-“উফ্…আপনিতো আমাকে পাগল করে দিবেন দেখছি!”
💞💞💞সমাপ্ত….💞💞💞
ধৈর্য ধরে সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।।