ঘাটে বসে পানিতে টাকনু অব্ধি পা ভিজিয়ে বসে আছে তনিমা,,,,
শরীরে ১২ হাত প্যাঁচানো শাড়ি!
এতটুকু মেয়ে তনিমা,,শাড়ি পড়তে জানেই না তেমন!
তারপর ও মায়ের জোরাজোরিতে পড়তে হলো তাকে!
মুল্লা বাড়ির মেয়ে তনিমা,,
বাবা নসিব মিয়া গ্রাম্য মুল্লা,সবাই তারে নসিব মুল্লা বলেই ডাকে!
গ্রামে তনিমার বাবার ডাক নাম অনেক,,,
বাবা মুল্লা হওয়ায় তনিমাদের কিছু সীমারেখার ভেতরে চলতে হয়!
তনিমাকে ক্লাস ৮ম পর্যন্ত পড়িয়েই পড়ার চ্যাপ্টার শেষ করে দিয়েছেন নসিব মিয়া!
তনিমার পড়ার প্রতি প্রবল ইচ্ছা থাকলেও বাবার সামনে কথা বলার সাহস নেই তার!
প্রচণ্ড বদমেজাজি বলে নসিব মিয়া!
বাড়ির এড়িয়াটা নসিব মিয়া টিন দিয়ে ঘেরা দিয়েছেন যাতে পরপুরুষদের দৃষ্টি না পড়ে বাড়ির উপর!
কিন্তু……নসিব মিয়ার ভুলটা এক জায়গায়!
উনার তনিমাসহ তিন মেয়ে
তাদের মধ্যে তনিমাই একটু শ্যাম বর্ণের,,,
তাই তনিমাকে সবাই আড়চোখে দেখে কেমন জানি!
তনিমা ছোট সবার থেকে,,
ওর থেকে বড় বোনরা এখন ক্লাস টেনে একজন,আর ইন্টারে একজন!
আর তনিমা?
তাকে তো ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়িয়েই ক্ষ্যান্ত নসিব মিয়া!
নসিব মিয়ার বড় মেয়েরা নুসাইবা,,ও নাহুরা দুজনেই বোরকা পড়ে প্রতিদিনই বাহিরে বেড় হয়,,আর তনিমা?
সে বাড়ির বাহিরে বের হতে হলে বোরকার প্রয়োজন বোধ করে না কেউই!
কারণ তনিমা কালো,,তনিমার দিকে কে ই বা তাকাবে!
সবাই তো তাকাবে দুই বোন নুসাইবা আর নাহুরার দিকে!
তাই নিশ্চিত থাকেন নসিব মিয়া!
নুসাইবা আর নাহুরাকে বোরকা এনে দিলেও তনিমার জন্য কখনো আনার প্রয়োজন বোধ করেন নি নসিব মিয়া!
যত চিন্তা তো বড় মেয়েদের নিয়েই উনার,,কারণ তারা যে তনিমার থেকে তিনগুণ ভারী রূপসী!
তনিমা যায় বাড়ির বাহিরে বোরকা ছাড়াই যায়,,,
মাঝে মাঝে অস্বস্তি হয় তনিমার,,কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না!
বোরকার পড়ার ইচ্ছা জাগে তনিমার,,তার ও ইচ্ছে হয় বাহিরে গেলে বোরকা পড়ে যাবে!
কিন্তু তাকে তো বোরকা কেউ এনেই দেয় না পড়বে কেমনে?
তনিমাকে প্রায়ই বাবার গ্রামের মসজিদটাতে খাবার নিয়ে যেতে হয়,,
গ্রামের মসজিদেরই ইমাম তিনি……
সেদিন ও বাবার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিল তনিমা!
কিছু মাঝরাস্তায় যেতেই কিছু বখাটে ঘিরে ধরলো তনিমাকে!
তনিমা বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো,,,
চেয়ারম্যান চাচার বড় ছেলে সাইজানকে দেখে ভয়টা দ্বিগুণ আকারে বেড়ে গেলো তনিমার!
পাশ ঘেষে চলে যেতে নিলে সাইজান আটকায় তনিমাকে!
বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলে সাইজান,,,
-তর এত্ত ভাব কিসের রে তইন্না? কালো কাকের এতো ভাব মানায় না কি?
তর তো সৌভাগ্যরে তইন্না তরে আমার দিলে লাগছে!
তর হাতটা দে তো তইন্না,,
তনিমার হাত টেনে ধরতে চাইলো সাইজান,,
তনিমা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাইজানকে ঠেলে দৌড় দিলো মসজিদ প্রান্তে!
বাবার কাছে এসে সব বললো তনিমা,,
কিন্তু নসিব মিয়া হেসেই উড়িয়ে দিলেন বিষয়টি!
উনার মতে এমন কালো মেয়ের সাইজানের মতো বড়লোক,,ভদ্র,,রাজপুত্রের মতো দেখতে পুলা কি তনিমার মতো কালোর দিকে নজর দিবো?
নসিব মিয়া জানেন না,,
সাইজান তনিমার দিকে কোন ভালো নজরে হাত বাড়ায় নি!
সে তনিমার শরীরের ভাজেই আকৃষ্ট হয়ে হাত বাড়িয়েছে!
কালো হোক বা ফর্সা নসিব মিয়ার উচিত ছিলো তনিমাকেও বোরকায় আবৃত রাখা!
কিন্তু নসিব মিয়ার মতো মা-বাবার কি আর বুঝে সব!
তাই তো যখন তাদের কালো মেয়েটাও ধর্ষণ হয়ে রাস্তায় পড়ে তাকে তখন তাদের আফসোস বেড়ে যায়!
তনিমা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসে!
বাবার উদাসীনতা,অবহেলা বড্ড কষ্ট দেয় তনিমাকে!
তনিমার গাল বেয়ে পুকুড়ের ঘাটে একফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে!
তনিমা সেটা আটকায় না বা মুছে ও নেয় না!
তার কান্নার কারণ যতেষ্ট রয়েছে!
বড় বোনদের রেখে তনিমাককে বিয়ে দিতে বাবা-মা উঠে পড়ে লেগেছেন!
কারণ একটাই মেয়ে তার কালো,,,সুযোগ পেলে হাতছাড়া করা যাবে না!
বয়স ছোট হলে কিচ্ছু হয় না,,বিয়ে হইলে সব ঠিক হইয়া যায়!
আজ তনিমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিলো,,
আসলে ছেলেপক্ষ বললে ভুল হবে মুরব্বীপক্ষ,,
তাই তাকে বাধ্য হয়েই ১২ হাতের শাড়িটা ছোট্ট গায়ে প্যাঁচাতে হয়েছে!
তনিমার জন্য যে প্রস্তাব এসেছে ছেলেটা প্রায় ৫০ উর্ধের বুড়ো……
আর তনিমার বয়সটা মাত্র ১৬ পেড়িয়েছে,,,।
অবশ্য তনিমার বয়সের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই,,
সে বিনাবাক্যে বাবার কথা মেনে নিতে রাজি,,কিন্তু তার মাথার উপর বড় বোনদের রেখে?
তা ও আবার এমন একটা প্রস্তাব?
আচ্ছা এতোই কি বুঝা হয়ে গেছে সে?
কালোরা কি সবার কাছে শুধুই বুঝা?
আচ্ছা কালোদের কি কোন ইচ্ছা,শখ,আহ্লাদ কিছুই থাকতে পারে না?
তনিমা কাঁদে,,দু হাতে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে থাকে!
আচ্ছা সব তনিমাদের জীবনই কি এমন?
প্রশ্ন জাগে তনিমার মনে!
তনিমা বড় বোন নুসাইবার ঘরের দরজায় ঠোকা দেয়!
নুসাইবা বিরক্তিভাব নিয়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে দরজার দিকে তাকায়!
তনিমাকে দরজার সামনে দেখে নুসাইবার রাগ হয় প্রচুর!
নুসাইবার রাগের কারণ
তনিমার গায়ের কালো রঙ,,
সে কিছুতেই মানতে পারে না তার বোনের গায়ের রংটা কালো!
নুসাইবার মতে বাবা-মা বংশের সবাই এতো সুন্দর আর তনিমা কোথা থেকে কালো রংটাই নিয়ে এলো!
নুসাইবা তনিমাকে নির্ঘাত ভাবতো পালক মেয়ে যদি সে তনিমাকে নিজ চোখে দেখতো না জন্ম নিতে মায়ের পেট থেকে!
নিজ চোখে সে দেখেছে তনিমাই ঔরসজাত সন্তান এ পরিবারের!
নুসাইবা আহত হয় তনিমাকে দেখে জন্মের সময়ই!
তখন নুসাইবার বয়স ৬,,,
আর নাহুরার বয়স ৪।
দুই বোন তনিমার জন্মের পর তনিমাকে দেখে বড্ড আফসোস করে,,,তারা এতো সুন্দর আর তাদের বোনই কি না দেখতে এতো বাজে!
-আপু আসবো?
তনিমার মুখে স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষা শুনে কপাট রাগ দেখিয়ে তনিমার দিকে তাকায় নুসাইবা!
তনিমা আমতাআমতা করে!
নুসাইবা ফোনটা কানে তুলে নেয় আবার!
তনিমা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেই ঘরের ভেতর ঢুকে যায়!
বোনের বিছানার পাশে শান্ত ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে!
নুসাইবা আপন মনে ফোনে কথা বলতে থাকে,,মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসিও দেয়!
তনিমা ভ্রু কুচকায়!
নুসাইবা বেশ কিছুক্ষণ পর ফোনটা রাখে!
ঘার ফিরিয়ে দেখে তনিমা দাঁড়িয়ে!
বোনের দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বলে তনিমা,,,
—-আপু ফোনে এভাবে কার সাথে কথা বলছিলে?
নুসাইবা বিরক্তি নিয়ে বলে,,
—কেন? আমার ফ্রেন্ডের সাথে!
—-আপু ছেলে বন্ধুর সাথে?
—হু
ছোট্ট করে উত্তর দেয় নুসাইবা!
তনিমা বোনের টেবিলের দিকে তাকায়!
টেবিলে ঠাস লাগানো হাদিসের বই,,,বাবাই সব হাদিসের বই এনে দিয়েছিলেন নুসাইবাকে!
তনিমা টেবিলের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বোনের দিকে উদাস নয়নে তাকায়!
নুসাইবার রাগ হয়!
তনিমা হতাশ গলায় বলে,,,
—আপু এই হাদিসের বইগুলোতে নিশ্চয়ই আছে ছেলে বন্ধু বানানো জায়েজ না!
এমনকই কোন পরপুরুষের সাথেও কথা বলা জায়েজ না,,আর তুমি কথার সাথে সাথে উচ্চস্বরেও হাসছিলা!
আপু এই আয়াতটা নিশ্চয়ই পড়েছ___
আল্লাহ বলেনঃ
“তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে পরপুরুষদের সাথে কোমল কন্ঠে কথা বলবে না। তা হলে যার অন্তরে রোগ আছে, সে প্রলুব্ধ হয়ে পড়বে। তোমরা স্বাভাবিক ভাবে কথা বল।” (সুরা আহযাব-৩২)
অনেকেই বলতে পারেন যে আমরা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবো। কন্ঠ কোমল করবো না। তাদেরকে বলতে চাই, এই আয়াতের দ্বারা তাফসীরবিদগণ প্রয়োজনীয় কথা বার্তা ছাড়া অন্যান্য কথাবার্তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
যেমন আল্লামা আলুসী রঃ বলেনঃ
“ভিন্ন পুরুষদের কথার জবাব দেয়ার সময় তোমরা বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ এবং নারীসুলভ কোমল ও নরম স্বরে কথা বলবে না, যেমন করে সংশয়পূর্ণ মানসিকতাসম্পন্ন ও চরিত্রহীনা মেয়ে লোকেরা বলে থাকে।”
আল্লাহ্ বলেছেনঃ
স্বাধীনভাবে লালসা পূরণ কিংবা গোপনে লুকিয়ে প্রেমলীলা করবে না” (সূরা আল মায়িদা: ৫)
তনিমা বোনের ক্ষেত্রে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো তাই এই দুইটা আয়াতের অর্থ বললো!
তনিমার কথা শেষ হতে না হতেই নুসাইবার রগ দপদপ করতে লাগলো রাগে ক্ষোভে!
সে বলল,,,
—তর কাছ থেকে এখন আমায় শিখতে হবে আমি কি
করবো আর কি করবো না!
তুই আমার থেকে বেশি শিখে নিয়েছিস হ্যাঁ?
বোনের চেঁচামেচি শুনে পাশে ঘর থেকে মা রাবেয়া বেগম ও মেঝ বোন নাহুরা ছুটে এলো!
তনিমা তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে!
নাহুরা তনিমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,,
—এই কালী তুই কি বলেছিস আপুকে যে আপু এতো রেগে গেলো,,হুম?
তনিমা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো,,,
—মেঝপু আমি আ…আপুকে ব…বলেছি অকারণে পরপুরুষদের সাথে কথাবার্তা,হাসি-ঠাট্টা জায়েজ না!
আর কিছু বলিনি আপু!
নাহুরা ধমকের সুরে বলল,,
—তুই আপুকে এসব বলার কে রে?
আপু তর থেকে এসব ভালো জানে,,তুই বলতে হবে না আপুকে কোনটা জায়েজ আর কোনটা নাজায়েজ…।
—কি হয়েছে,,ঘরে এতো চেঁচামেচি কিসের?
নসিব মিয়ার কন্ঠ শুনে সবাই চুপ মেরে গেলো!
ঘরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে,,,
নসীব মিয়াকে ভয় পায় সবাই,,
নুসাইবা কান্নার ভান করে ঠোঁট উল্টায়!
নসীব মিয়া সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলেন,,
—কি হয়েছে,,কাঁদছিস কেন তুই?
নুসাইবা বাবার প্রশ্নে ফুঁপিয়ে উঠে,,
নাহুরা বলে,,
—বাবা তোমার এই গুণধর ছোট্ট মেয়ে আপুর সাথে আজ বেয়াদবি করেছে,,আপুকে যা নয় তা বলেছে!
তাই বলি বাবা ওকে তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিয়ে দাও নইলে ও যা বাড় বেড়েছে!
নাহুরার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকায় তনিমা বোনের দিকে!
সে কখন বেয়াদবি করলো, আর কি ই বা যা তা বললো?
নসিব মিয়া মেয়ের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকান!
বাবার চাহনিতে মাথা নিচু করে নেয় তনিমা!
—তুই ওকে কি বলেছিস তনি?
বাবার প্রশ্নে কিছু বলতে গিয়েও আটকে যায় তনিমা!
বাবাকে এসব বললে নিশ্চয়ই এসব বিশ্বাস করবে না।
কারণ বাবা-তো দুই মেয়েকে অন্ধ বিশ্বাস করেন!
তনিমাকে চুপ থাকতে দেখে নসিব মিয়া ধমকে উঠেন!
রাবেয়া বেগম হেচকা টানে তনিমাকে ঘর থেকে নিয়ে বেরিয়ে যান!
তনিমা মায়ের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলে,,
—জন্মের পরপরই গলা টিপে মেরে দিতে মা!
বেঁচে যেতাম!
রাবেয়া বেগম মুখ লুকিয়ে চোখের জমানো জল শাড়ির আঁচলে মুছে নেন!
তনিমা মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে!
মায়ের শাড়িটা তখনো গায়ে প্যাঁচানো রয়েছে তনিমার!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে,,,
সত্যি সে ওতোটাও কালো নয়,,
তারপর ও বারবার কালো বলেই সবাই সম্বোধন করছে!
আচ্ছা আর যারা একেবারেই কালো তাদের অবস্থা নিশ্চয়ই আমার থেকেও শোচনীয়!
—-এবারের পক্ষ ও ফিরে গেলো!
ক্লান্ত কন্ঠে কথাগুলো বলে মেয়ের বিছানায় বসলেন রাবেয়া বেগম!
তনিমা চুলের খোঁপাটা ছেড়ে দিতেই কোমড় পেরিয়ে দীঘল কালো চুলগুলো ঢেউ আঁকাতে লাগলো!
তনিমা আপন ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,,,
—এবারের পক্ষ ফিরে গেলেও আরেক পক্ষ আসবে নিশ্চয়ই মা!
—তোর মতো কালো মেয়েকে কেউই নিতে আসবে না,,
এভাবে আসবে আর যাবে!
তনিমা মায়ের কথা না শুনার ভান করে কাপড় নিয়ে কলপাড়ে চলে গেলো!
কারণ মায়ের এমন কথা সে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত!
বরং এ ঘরের প্রতিটা সদস্যদের কাছেই অপদস্থ হয়ে আসছে দিনের পর দিন!
প্রথম প্রথম কষ্ট পেতো প্রচুর,,এখন আর এসব গায়ে মাখে না তনিমা!
—আপু তুই তো জানিস তনিমা এসব পছন্দ করে না!
তুই ওর সামনে এভাবে ফোনে কথা না বললেও পারতি,,
এখন যদি ও বাবাকে বলে দেয়?
বোন নাহুরার কথা শুনে মৃদু হাসলো নুসাইবা!
হেসে বললো নুসাইবা,,,
—ও বলবে আর বাবা বিশ্বাস করে নিবে তুই কিভাবে ভাবলি?
—হুম ঠিক বলেছিস!
আচ্ছা আপু তুমি তখন কার সাথে কথা বলছিলে?
—কার আবার,,,রাহবার এর সাথে!
কাল দেখা করার কথা!
—এসব কি ঠিক হচ্ছে আপু?
নুসাইবা বিরক্তি নিয়ে নাহুরার দিকে তাকালো,,
নাহুরা মুচকি হেসে বললো,,
—না মাননে আপু বলছিলাম বাবা জানলে তো পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে তোমার!
—আরে বাবাকে জানতে দিলে তো!
খিলখিল করে হেসে উঠলো দু বোন!
—বাবা আমায় একটা বোরকা এনে দাও না!
কাছুমাছু করে নসিব মিয়ার সামনে গিয়ে কথাটি বললো তনিমা!
নসিব মিয়া বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে বলেন,,
—বোরকা দিয়ে তোর প্রয়োজন কি?
—বাবা আপনি তো জানেন পর্দা সম্পর্কে,,তাই……
—তোর দিকে কেউ তাকাচ্ছে না!
যা তো এখন বিরক্ত করিস না!
তনিমা মৃদুগতিতে বাবার রুম ত্যাগ করলো!
—কি রে এভাবে মুখ ভার করে বসে আছিস কেন?
রাবেয়া তরকারীতে ঝোল দিতে দিতে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন!
তনিমা উদাস গলায় বললো,,
—মা বাবাকে বলবে যে আমি এস.এস সি টা দিতে চাই!
মেয়ের কথা শুনে রাবেয়া চমকান!
—মা বলবে বাবাকে?
রাবেয়া ইতস্তবোধ করেন!
করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকায় তনিমা!
মেয়ের মায়াবী মুখের অন্ধকার ভাবটা বিচলিত করে রাবেয়া বেগমকে!
—আ…আচ্ছা আমি কথা বলে দেখবো!
তনিমা খুশি হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে!
কুলাউড়া টু সিলেটের বাসে জানালার পাশ ঘেষে বসে আছে তনিমা!
সাথে বাবা নসিব মিয়া!
উদ্দেশ্য মামা বাড়ি!
জরুরী তলব করেছেন মামা,,সাথে তনিমাকে নিয়ে আসার ও তাগিদ দিয়েছেন!
তনিমার অজানা এতো জরুরী তলব তাও বা সাথে তনিমাকেও!
মামার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বাপ মেয়ে!
তনিমা অনেকদিন হলো আসে নি মামার বাসায়!
দারোয়ান গেট খুললে দ্রুত গতিতে নসিব মিয়া ভেতরে ঢুকেন,,বাবার পেছন পেছন তনিমা ও দৌড়ায়!
ঘরে ঢুকতেই সাদরে গ্রহণ করেন মামা-মামী তাদের!
তনিমা চারিদিকে চোখ বুলায়!
ঘরটি বেশ নজরকাড়া!
নসিব মিয়াকে সোফায় বসতে তাগিদ দেন মামা!
মামা বলতে শুরু করেন,,
—আপনাকে একটা জরুরী কাজে ডেকেছি,,ফোনে হয়তো আপনি আমার অবস্থাটা তেমন বুঝতে পারতেন না!
তনিমার মামীকে তো দেখছেন পুরো বাড়িতে ও একা থাকে,,
আর আমি সারাদিন অফিসে থাকি!
বড় ছেলেটা বিদেশ আর,,ছোট ছেলে হাফেজ ও সারাদিন মাদ্রাসার কাজে ব্যস্ত!
তাই ও বলছিলো যে তনিমাকে আনতে,,,
নুসাইবা নাহুরাকে আনা সম্ভব না জানি ওরা পড়ালেখায় ব্যস্ত!
তাই তনিমাকে চেয়েছিলাম আমাদের কাছে রাখতে!
ও যদি এখানে থাকতো তাহলে আমাদের ভালো লাগতো!
নসিব মিয়া ইতস্ততবোধ করেন!
মামা উদগ্রীব নয়নে তাকিয়ে থাকেন,,,
নসিব মিয়া বলেন,,
—মেয়েটাকে আমি এইবার ভর্তি করবো আবার!
ও কি করে………
কথার মাঝে ফোড়ন কাটেন মামী শায়রা হোসেন!
—ভাই সাহেব আপনি চিন্তা করবেন না,,ওকে আমাদের এখানে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো!
নসিব মিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচেন!
মনে মনে ভাবেন তনিমার পড়ালেখার খরচের ভার থেকে বেঁচে গেলেন তিনি!
তনিমা তখন নীরব শ্রোতা!
জীবনের মোড় হঠাৎ করেই এভাবে ঘুরে যাচ্ছে!
কি হতে যাচ্ছে এই ক্ষণিকের জীবনে,,
আর কতো যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে তাকে……
—তনিমা মা এদিকে রান্নাঘরের দিকে যা তো চুলোয় ভাত তরকারী একটু বসা!
সা’দ আসবে মাদ্রাসা থেকে,
ও খাবার না পেলে ভীষণ রাগ করবে!
তিন দিন পেরিয়েছে মামার বাসায় আছে তনিমা!
প্রথম দিন ভালো কাটলেও এই দুইদিন একদম ভালো কাটেনি তনিমার দিন-রাত!
মামী ছলে কৌশলে শুধু রান্নাঘরের দিকেই তনিমাকে পাঠান!
প্রথম দিন মামা-মামীর যত্ন আত্মী দেখে তনিমার মনে হয়েছিলো এখন বুঝি সে ভালো থাকবে!
এখানে আর তাকে কেউ কালো বলে পুড়াবে না,,
কেউ আর কোন বুড়োর গলায় ঝুলাতে চাইবে না,,
কিন্তু তার ধারণা পাল্টাতে বেশ সময় নিলো না!
মামীর ছলাকলা দেখে তনিমা এতটুকু বুঝে গিয়েছে যে,,এই বাড়িতে থাকে কিজন্যে ডাকা হয়েছে!
রান্নার জন্য বাড়তি খরচের আর আয়া রাখা লাগবে না,
ঘরের এই বাড়তি খরচটা ঘুচে যাবে এবার,,তনিমা আছে যেহেতু সে ই এবার দেখবে এসব!
তাকে তো এজন্যই আনলাম!
এই কথাটাই কাল মামীকে বলতে শুনেছে মামাকে!
তনিমা চমকায়,,কিন্তু আবার কি মনে হতেই তাচ্ছল্য হাসে!
এমনটা হওয়ারই কথা!
চুলো ভাত বসাতে বসাতে ভাবে তনিমা,,
রান্নাটা সে শিখেনি!
কখনো রান্নার প্রয়োজন ও পড়ে নি!
মা ই রান্নার ধারেকাছে যেতে দেয় নি তনিমাকে!
কারণ তনিমা কালো,,চুলোর আগুনের তাপে যদি আরো কালো হয়ে যায় তাহলে ওকে বিয়ে করবে কে?
এই ভয়েই মা কখনোই তনিমাকে রান্নার কাজ দেন নি,,!
তাই রান্নায় খুবই কাঁচা হাত তনিমার!
মামীকে ডাকে তনিমা!
শায়রা হোসেন এগিয়ে আসেন রান্নাঘরের দিকে!
তনিমা আমতাআমতা করে বলে,,
—মামী রান্নাটা তো পারি না!
কখনো রাধা হয় নি তো………
শায়রা হোসেন মুখ বাঁকান!
তনিমা মাথা নিচু করে!
শায়রা হোসেন অবজ্ঞা করে তনিমাকে বলেন,,
—শিক্ষা-ধীক্ষা, রূপ তো কিছুই নাই মেয়ে!
এখন দেখছি গুণটাও নাই!
তা মেয়ে সংসার করবা কেমনে?
রূপ দেখিয়ে তো আর সংসার করতে পারবা না তা তো নেই ই!
এখন যদি গুণটাও না থাকে!
তা রান্নাবান্না শিখলা না কেন মেয়ে?
তোমাকে কি এখানে আমি মাথায় তুলে খাওয়াবো!
তনিমা বিস্মিত হয়!
নিজেকে সামলে নিয়ে ভারী গলায় বলে,,
—না মামী,,আমাকে একটু দেখিয়ে দিবেন আমি শিখে নিবো!
শায়রা হোসেন বিরক্ত হোন!
দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,,
–হ্যাঁ হ্যাঁ ফ্রিজ থেকে ওই মাছটা বের করো,,আর শসা গুলো বের করে নিও!
তনিমা মৃদু পায়ে ফ্রিজ খুলে একেএকে তরকারিগুলো বের করে মেঝেতে রাখে!
শায়রা হুকুমের সুরে বলেন,,
–বটিটা ও নাও!
তনিমা মাছ হাতে নিয়ে বটিটার উপর বসে!
শায়রা হাত দিয়ে ইশারা ইঙ্গিতে বলে দেন!
দাঁড়ালো বটির দিকে তাকিয়ে তনিমার হাত কাঁপে!
সে কখনোই মাছ কাটেনি!
তনিমা করুণ চোখে মামীর দিকে তাকায়!
ভীষণ ভয় পাচ্ছে সে!
শায়রা হোসেন বিরক্তি নিয়ে বলেন,,
—চেয়ে আছো কেন?
কাটো!
তনিমা ভয়ে ভয়ে মাছ কাটতে লেগে যায়!
শায়রা হোসেন দেখলেন তনিমা এখন ঠিক করে মাছ কাটতে পারছে তাই তিনি আবার নিজ রুমের দিকে হাটা দেন!
মাছের লেজটা কাটতে গিয়ে তনিমার হাতে লেগে যায়!
গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে হাত দিয়ে!
তনিমা মাগো বলে আর্তনাদ করে!
এই আর্তনাদ তনিমা ছাড়া কেউই শুনতে পায় না!
—মেয়েকে এইভাবে রেখে আসলেন কি মনে করে বলেন?
মেয়েটা এইভাবে একা কোথাও থাকে নি!
রাবেয়া স্বামীর পাশে বসে কথাটি বললেন!
নসিব মিয়া ভ্রু ভাজ তুলে বললেন,,
—মেয়েকে কি আমি খালে ফেলে দিয়েছি না কি?
তোমার ভাইয়েরই তো কাছে রেখে এসেছি!
আমি তো যেচে রেখে আসি নি,,তোমার ভাই ভাবীই বললো এতো করে!
—তারপর ও আমার মনটা কেমন জানি করছে!
ওকে আপনি নিয়ে আসুন!
স্ত্রীর কথায় নসিব মিয়া গুরুত্ব দেন না!
তিনি কথা পাল্টে বলেন,,
—আমি মসজিদে যাচ্ছি!
দুপুরে এসেই খাবো!
নসিব মিয়া বেরিয়ে যান!
রাবেয়া বেগম আহত হন মেয়ের প্রতি স্বামীর এমন উদাসীনতায়!
নুসাইবার ঘরে যান রাবেয়া বেগম!
—আমাকে তোর মামার নাম্বারে কল ধরিয়ে দে তো মা!
মেয়েটা যে কি করছে কে জানে?
নুসাইবা বিরক্তি নিয়ে বলে,,
—ওর জন্য তোমার সব মায়া মা!
আমাদের থেকে তুমি ওই কালীকেই বেশি ভালোবাসো তাই না?
রাবেয়া বেগম ক্ষুদ্ধ হোন!
তিনি মেয়ের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি দিয়ে বলেন,,
—তোদের নিজের মেয়ে বলতেও রাগ হয় জানিস!
নিজের বোনকে তোরা অপদস্থ করতে ভাবিস না!
গায়ের রংটা কালো বলেই ওকে তোরা যা নয় তা বলিস!
এমনকি তোর বাবা একা ওকে এতদূর ফেলে আসলো তা ও তোদের এতোটুকু চিন্তা হচ্ছে না!
কেমন বোন তোরা?
যে জায়গায় তোরা জানিস তোর মামী কেমন?
নুসাইবা ঝাঁঝালো সুরে বলে,,
—হ্যাঁ হ্যাঁ ওকে নিয়ে তো তোমার যা ই চিন্তা!
আমাদের যদি বাবা এইভাবে দূরে দিয়ে দিতো তাহলে হয়তো তোমার এতো চিন্তা হতোনা বুঝিনা আমরা!
ওই কালী তোমাকে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে!
—ছিঃ তোদের চিন্তাধারা বড় ভাবাচ্ছে আমায়!
তোদের ভেতর এতো হিংসা নিয়ে ঘুরিস!
তনিমা যেমন আমার মেয়ে তেমনি তোরাও,,তনিমার জন্য আমার যে ভালোবাসা তোদের জন্য ও আমার তেমন!
আচ্ছা বাদ দেই তোদের সাথে কথা!
ফোন লাগিয়ে দে আমায়!
রাবেয়া বেগম নিজের হাতের সস্তা বোটম মোবাইল এগিয়ে দেন মেয়ের দিকে!
নুসাইবা ছোঁ করে মোবাইল মায়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ডায়াল করে মামার নাম্বারে!
—আসসালামু আলাইকুম!
আপা ভালো আছো?
রাবেয়া বেগম শুকনো হেসে বললেন,,,
-হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ!
তনিমা কোথায় মাহতাব!
ওকে একটু ফোনটা দাও,,
কথা বলি দু এক!
বোনের কথায় ইমতিয়াজ হোসেন ইতস্তত করেন!
ভয় হয় যদি তনিমা বলে দেয় ওকে দিয়ে ওর মামী কাজ করাচ্ছে!
ভাইকে চুপ থাকতে দেখে আরো একবার তাগাদা দেন রাবেয়া বেগম!
ইমতিয়াজ হোসেন মিথ্যে বলে,,
তিনি অফিস আছেন!
রাবেয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফোনটা কেটে দেন!
এরই মধ্যে মামাকে বলে নাইনে এডমিশন নিয়ে নেয় তনিমা!
অনেক কাটখোট্টা পোহাতে হয়েছে এতে তাকে!
মামা প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না!
তিনি বিভিন্ন কৌশল আঁটছিলেন যাতে ভর্তি না করান!
তনিমা তাই বলেছিলো,,
সে চলে যাবে বাড়িতে!
এতেই মামা কিছুটা দমে যান!
তনিমা চলে গেলে বিনে পয়সায় কাজের লোক হারাবেন!
তাই রাজি হয়ে যান শেষে মামা!
তনিমা এতেই খুশি হয়!
পড়ালেখাটা শেষ করতে চায় সে!
বড্ড ইচ্ছে যে সে ও বোনদের মতো পড়বে!
কেউ তাকে আর অশিক্ষিত বলবে না!
দেখতে দেখতে কেটে যায় পাঁচটি মাস!
তনিমা এমনি এক দিনে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রান্না করছে!
তনিমা এখানে এসে হিজাব করছে সচরাচর!
কারণ এঘরে একজনন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আছে যে!
তার সামনে নিজেকে যথাসম্ভব ঢেকে রাখে তনিমা!
কেন যেন বেশ অস্বস্তি হয় লোকটিকে দেখলে তনিমার!
আজ গরমটা বেশ পড়েছিলো!
তাই হিজাবটা গায়ে জড়িয়ে রাখতে পারে নি তনিমা!
রান্নাঘরের টেবিলে হিজাবটা রেখে চুলোয় মাছ ভাজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তনিমা!
হঠাৎ করে পেটের মধ্যে কারো স্পর্শ পেয়ে আৎকে লাফিয়ে উঠলো তনিমা!
পেছনে তাকিয়ে সা’দকে দেখে ভয় পেলো তনিমা!
হিজাবিটা টান দিয়ে এনে মাথাসহ শরীর ঢেকে নিলো সে!
সা’দ হাসলো তনিমার দিকে চেয়ে!
তনিমার গা ঘিনঘিন করে উঠলো!
সা’দ একপা এগিয়ে এসে বললো,,
—উহু এতো ভয় পাচ্ছিস কেন তনিমা!
ঘরে কেউ নেই!
মা পাশের বাসার আন্টির কাছে গিয়েছেন,,আসতে আসতে লেট হবে!
চল আমরা কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটাই!
তনিমার দম আটকে যেতে চায় সা’দের কথা শুনে!
পাঁচটি মাসে সা’দ কখনো তনিমার সাথে কথা বলে নি!
কখনো তাকায় নি সরাসরি!
আর সে কি না এভাবে একা পেয়ে একটা মেয়েকে?
আসলে সা’দ বাহিরেই দেখায় সে খুব ভালো,,
কিন্তু ভেতর ভেতর জঘন্য একটা ব্যক্তিত্বে ভরা মানুষটার সে কি আর কেউ জানে?
তনিমার গায়ের কাঁপুনি বেড়ে যায়!
সা’দ আরো এক পা এগিয়ে যায় তনিমার দিকে!
তনিমা পেছন থেকে গরম কড়াইটা হাতে নিয়ে সা’দের দিকে ইশারা করে বলে,,
—খবরদার তুই যদি এক পা ও আগাস!
তাহলে এই গরম কড়াই দিয়ে তোকে জ্বালিয়ে দিবো!
সা’দ ভয় পায় না!
সে গা গুলানো হাসি হাসে!
তনিমা ভয় পায় ভীষণ!
সা’দ বলে,,
–উহু এতো তেজ দেখাতে নেই তনিমা!
তুই তো এমনিই কালো!
তোকে কেউ ভালোবাসবে না!
আমি তোকে ভালোবাসবো!
আয় আমার কাছে আয়!
তোর কিছুর অভাব হবে না!
তোকে আর কাজ করতেও হবে না!
সা’দের লোভাতুর প্রস্তাবে তনিমা দমে না!
সে হাতের কড়াইটা এগিয়ে সা’দের হাতে লাগিয়ে দেয়!
সা’দ হাত চেপে ধরে বসে পড়ে মেঝেতে!
তনিমার রাগে রি রি করে শরীর!
সে সা’দের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে বলে,,
—এভাবেইই এভাবেই জিনাকারীরা শাস্তি পায় জানিস?
যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার আশা করে তাদের শাস্তিটা এর থেকে ভয়ংকর হয়!
তোর হাতে তো আমি ছ্যাকা দিয়েছি মাত্র,,,আগুন লাগাই নি!
কিন্তু যারা ব্যাভিচারের পথে হেটে যায় তাদের আল্লাহ তাদের বিচার দিন আগুনে পুড়িয়েই শাস্তি দিবেন!
এইভাবে যে হাত দিয়ে তুই আমায় জিনার দিকে ডাকছিলি এইভাবে এই হাত দেখছিস এই হাত ঝলসে দেওয়া হবে!
আমি তো মাত্র ছ্যাক দিয়েছি রে জা*****
আরে তোকে কি বলছি তুই তো মাদ্রাসার টিচার!
তাহলে তোর তো এসব জানারই কথা!
তারপর ও………
তনিমা হাতের গরম কড়াইটা আবারও সা’দের দিকে এগিয়ে নিলে
সা’দ আঁতকে পিছিয়ে যায়!
তনিমা হেসে বলে,,
—আমি কালো হতে পারি এই দুনিয়ার মানুষের কাছে!
কিন্তু আমি আমার আল্লাহর সৃষ্টিতে সুন্দর!
কারণ আল্লাহর কোরআনে বলে দিয়েছেন,,
“তিনি মানুষকে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করেন”
আমার এতে কোন সন্দেহ নেই!
আমার এই আকৃতি অবশ্যই সুন্দর!
তোরা কি ভাবিস, নারী কালো হয়েই তারা ঠেকে যায়?
আরে না! যারা মূর্খ তারা ঠেকে!
আর তোদের মতো অমানুষদদের ডাকে তারাই সারা দেয়!
শুনে রাখ আমি আমার ইজ্জত রক্ষার্থে তোকে যদি এই মুহূর্তে মেরে ফেলতে হয় তো মেরে ফেলবো!
সা’দ ভীষণ অবাক হয় তনিমার এই রূপে!
সে জানতো তনিমা ভীতু,,
কারণ মামীর এতো অত্যাচারেও তনিমা টু শব্দটি করতো না!
এতেই সা’দ তনিমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো!
কিন্তু আজ সা’দ অন্য এক তনিমাকে দেখলো!
এ তনিমাকে সা’দের চিনতে বড় কষ্ট হচ্ছে!
নিজের হাতের দিকে তাকালো সা’দ কালচিটে দাগ বসে গেছে!
জ্বালাপোড়া করছে ভীষণ!
তনিমার একটু আগের কথা সা’দ নিজের মনে আওড়ালো!
আসলে সে কি করতে যাচ্ছিল?
সে তো সব জানে?
হাতের ফোচকা উঠা জায়গাটায় সা’দ হাত বুলাতে লাগলো!
তনিমা সেদিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,,
—এভাবে ঝলসে যাওয়া জায়গায় হাত দিয়ে ঘষবেন না!
নইলে জ্বালাপোড়া আরো বেড়ে যাবে!
ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছেন সেদিক দিয়েই চলে যান!
নইলে………
তনিমা আর বলতে পারে না!
সা’দ দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে চলে যায়!
তনিমা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে!
এতোক্ষণ সে কি বলছিলো?
এতো শক্তি সে কোথায় পেলো?
এতো কথা কিভাবে সে বললো?
আচ্ছা সা’দ যদি বলে দেয় মামীকে ছ্যাক দেওয়ার কথা?
কি বলবে মামীকে সে?
মামী কি বিঃশ্বাস করবে কিছু!
—মামী তুমি সরাসরি একথা আমায় বললেই পারো যে এঘরে আমায় তোমার কাজের জন্যই এনেছো!
এতে আমার কোন কষ্ট হবে না মামী!
কষ্ট পেয়ে,,অপদস্থ হয়ে হয়ে আমার তা সয়ে গেছে মামী!
খুব শান্তস্বরে কথাগুলো শায়রা হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলে তনিমা!
আজ ১৫ দিন হলো শায়রা হোসেনের বড় ছেলে মাহতাব দেশে এসেছে!
দেশে এসেই মাহতাবের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করে দিয়েছেন শায়রা হোসেন!
পাত্রী ও পেয়ে যান!
সেই সুবাদেই আজ মাহতাবের গায়ে হলুদ!
মামী আজ সকাল ধরেই তনিমাকে একটিবারের জন্য ও রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার ফোরসত করে দেন নি!
একটার পর একটা কাটাকুটি,,রান্না করা সব মিলিয়ে তনিমার ভীষণ কান্না পায়!
মামীকে কথাটি জিজ্ঞেস করার পরই শায়রা হোসেন বিচলিত হোন!
তনিমার প্রশ্নের উত্তর কি দিবেন ভাবছেন তিনি!
তিনি তো নসীব মিয়াকে কথা দিয়েছিলেন তনিমা এখানে ভালো করে পড়বে আর শুধু শায়রা হোসেনের সঙ্গী হবে!
কিন্তু তিনি তার আসল উদ্দেশ্যটা প্রকাশ করেন নি নসিব মিয়ার সামনে!
শায়রা হোসেন আমতাআমতা করেন।
তনিমা হেসে বলে,,
—মামী আমি জানি!
তুমি বিচলিত হইয়ো না!
আমাকে তুমি যা কাজ করার কথা বলবে তা করতে আমি বাধ্য,, তা আমি নির্ধিদ্বায় করেও দিবো!
কিন্তু প্লিজ মামী আমার মা যেন এসব বুঝতে না পারে!
নাহলে তিনি বড্ড কষ্ট পাবেন!
মামী আমি কি বলছি বুঝতে পারছো?
তনিমার দিকে তাকান শায়রা হোসেন!
মেয়েটা এতো স্পষ্টভাষী!
সবকিছুই স্পষ্ট করে বলে দিতে যেন সে পারদর্শী!
শ্যাম বর্ণের মেয়েটির ভেতর যেন আল্লাহ গুণে গুণে ভরপুর করে দিয়েছেন!
শান্তশিষ্ট,নম্র মেয়েটাকে কি করে এতো কষ্ট দেন তিনি!
শায়রা হোসেন নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হোন!
তনিমা মামীর উত্তরের আর আশা করে না!
সে সবজি কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে!
পুরো বিল্ডিং এ মানুষদের সমাগম বেড়েছে!
আর কিছুক্ষণ পর তনিমার পরিবারের সকলেই এসে পড়বেন তাই মামীকে আগে থেকে সতর্ক করে দেয় তনিমা!
শায়রা হোসেন তনিমার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন!
আস্তে আস্তে তনিমার পাশে গিয়ে বসেন!
তনিমা তখন একমনে কাজ করছে!
শায়রা হোসেন তনিমার মাথায় হাত রাখেন!
মামীর দিকে অবাক নয়নে তাকায় তনিমা!
শায়রা হোসেন হেসে বলেন,,
—তুই যা রেডি হো গিয়ে!
কিছুক্ষণ পরই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে!
ষ্টেজে যাবি না?
তনিমা বিস্মিত হয় মামীর কথায়!
আবার নিজেকে সামলে নেয়!
মামী হয়তো এখন থেকেই তনিমার সাথে ভালো ব্যবহার করার প্রেকটিস করছেন যাতে পরে মা-বাবার সামনে ধরা পড়তে না হয়!
শায়রা হোসেন আবার ও তাগাদা দেন!
তনিমা এবার মুরগি হাতে নেয়!
মুরগির পা কাটতে কাটতে বলে,,
—মামী জানো তো গায়ে হলুদ ইহুদীদের কালচার!
এটা পালন করা কবীরা গুনাহ!
—মানে?
গায়ে হলুদ মাখানো ও কি কবিরা গুনাহ?
—-না গায়ে হলুদ লাগানো জায়েজ আছে,!
কিন্তু……বলছি শুনো!
ফার্মের সাদা মুরগিটা আধা কাটা অবস্থায় পাশে রেখে বলতে লাগলো তনিমা,,
— বিয়ের সময় বর ও কনেকে আকর্ষনীয় পোষাকে সাজানো ও তাদের গায়ে হলুদ মাখানো জায়েয আছে।
যেমন একদা হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাযিঃ) হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এলেন। তখনো তার গায়ে হলুদের চিহ্ন ছিল।
হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন আমি এক আনসার মহিলাকে বিয়ে করেছি। একথা শুনে হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৌনতা অবলম্ভন করলেন ৷
অর্থাৎ তিনি সম্মতি দিলেন৷ (বুখারী শরীফ)
কিন্তু আমাদের দেশে গায়ে হলুদের নামে কিছু কুৎসিত রেওয়াজ বা রীতির প্রচলন রয়েছে। যা ইসলামতো স্বীকৃতি দেয়ই না,বরং দিয়েছে অভিসম্পাত।
এমনকি এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করায় গোনাহে কবীরার পাশাপাশি ঈমানও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। যেমন- ‘গায়ে হলুদ’ বা ‘হলুদ বরণ’।
সমাজে বিয়ের মতো একটি পবিত্র আয়োজনকে অ-পবিত্র করতে যা যা প্রয়োজন,
সবই করা হয়ে থাকে এই আয়োজনে। যেমন মেয়েকে সাজিয়ে মঞ্চে প্রদর্শণ করা হয়।
আর উভয় পক্ষের দর্শনার্থীগণ গায়রে মাহরাম মেয়েকে দ্বিধাহীনভাবে দেখেতে থাকে ও তার সঙ্গে সেলফি তুলে এবং মেয়ের শরীরে হলুদ মেহেদি মেখে দেয়৷ অপরদিকে একজন গায়রে মুহাররাম ছেলেকেও দ্বিধাহীনভাবে মেয়েরা শরীরে হলুদ
মেহেদি মেখে দেয়৷ যা ইসলামী শরীয়াতে সম্পূর্ণরুপে হারাম। আর উক্ত অনুষ্ঠানে তো সাউন্ড সিস্টেম থাকছেই৷ যার মাধ্যমে বাজানো হয় হিন্দি-বাংলাসহ রোমান্টিক বিভিন্ন অশ্লীল গান।
যা নিতান্তই গর্হিত কাজ ও গোনাহে কবিরার পাশাপাশি কুফুরীতেও পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ যেমন- ফতোয়ায়ে শামীতে বর্নিত আছেঃ গান-বাদ্য শোনা হারাম।
গান-বাদ্যের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করা ফাসেকী এবং সে অনুষ্ঠানের স্বাদ উপভোগ বা আনন্দ উল্লাস করা কুফরী। (ফতোয়ায়ে শামী ৬/৩৪৮-৩৪৯)
অতএব প্রচলিত গায়ে হলুদ বা হলুদ বরণ অনুষ্ঠান ইসলামী শরিয়াতে সম্পূর্ণরুপে নাজায়েয ও হারাম৷
আর এটা ইহুদীদের কাছ থেকেই এসেছে!
“আর যারা মুশরিকদের অনুসরণ করে তারা তাদেরই দলভুক্ত ”
[আল-কোরআন]
শায়রা হোসেন কিছু না বলে চুপ করে রইলেন,,
তনিমা বললো,,
—মামী এই হলুদেও তো ভাইয়াকে কতো পরনারীরা হলুদ মাখাবে!
যেটা ভাইয়াকেও গুনাহগার বানাবে সাথে তোমাদের ও গুনাহগার হতে হবে!
তনিমা কান চেপে ধরলো হুট করেই!
শায়রা হোসেন ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বললেন,,
—কি হয়েছে রে তোর এইভাবে কান চেপে ধরলি কেন?
—মামী শুনতে পাচ্ছো মিউজিকের কি আওয়াজ?
—হুম এখনকার ছেলে/মেয়ে একটু আধটু তো উল্লাস করবেই!
তনিমা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,,
—এতোক্ষণ তাহলে কি বললাম মামী!
শুনো মামী!
রাসূল ﷺ বলেছেন, “অবশ্যই অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু লোক আসবে যারা যিনা, রেশম, নেশাদার দ্রব্য ও গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে।”
(সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫৫৯০, হাদিসের মান : সহিহ হাদিস)
আর এখনকার যুগের মুসলিমরা এসব কিছুকে আর হারাম মনে করে না!
শায়রা হোসেন উঠে গেলেন!
তনিমার সব কথা ঠিক তিনি জানেন!
সা’দ ও নিষেধ করেছিলো মাকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান যাতে না হয় বাড়িতে!
কিন্তু মাহতাব মানে নি,,
ফ্রান্স ফিরতি মাহতাব এসব কি আর মানছে!
দেশে থাকতে একটু আধটু ধর্মের জ্ঞান থাকলেও
বিদেশ গিয়ে সব যেন লাঠে উঠিয়েছে!
তাই তো সা’দ ও রুমের দরজা বন্ধ করে আছে রাগ করে!
তনিমা আবার ও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো!
শায়রা হোসেন উঠে তনিমার দিকে তাকিয়ে ভাবেন,
মেয়েটা অত্যন্ত বিনয়ী!
কোন দিক দিয়েই কম নয় শুধুমাত্র গায়ের রংটা!
শায়রা হোসেন বলেন,,
—আচ্ছা তুই এখন রুমে যা!
আমি ই করে নিচ্ছি এসব।
তোর বাবা-মা এসে গেছেন হয়তো দেখ গিয়ে!
—না মামী! তুমিই বরং ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও!
বাবা-মা এলে জানিয়ে দিও!
শায়রা হোসেন আজ তনিমার সাথে রুড বিহেভ করলেন না!
তিনি মিষ্টি ধমকে তনিমাকে পাঠিয়ে দিলেন রুমে!
তনিমা মুখের নিক্বাটা টেনে রান্নাঘর থেকে বের হলো!
সেদিনের সা’দের ঘটনার পর থেকেই তনিমা নিক্বাব পড়তে শুরু করে!
সে আর ভুলেও কখনো সা’দের সামনে নিক্বাববিহীন পড়ে না!
মামা-মামী তা দেখে আপত্তি করলেও তনিমা নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে!
কারণ শয়তান মানুষকে খারাপ প্ররোচনা প্রতি পদে পদে দিবেই!
আর দুর্বল ঈমানদাররা সে প্ররোচনায় পড়ে যাবে!
তনিমা কালো হলেও এখন বুঝে তার কালো বা ফর্সায় কিছু যায় আসে না!
বেপর্দা নিগ্রোর দিকেও কারো লুলোপ দৃষ্টি পড়তেই পারে!
এখানে কালো বলে কেউ তাকাবে না এমন কথা মানসিক ভারসাম্যহীন কথা বৈ আর কিছুই না!
সা’দ সেদিনের পর থেকে তনিমার সামনে খুব কমই পড়ে!
পড়লেও তনিমার দিকে চোখ তুলে তাকায় না!
অপরাধবোধ কুড়ে কুডে খাচ্ছে যেন সা’দকে!
তনিমার কাছে মাফ চাওয়ার ও কোন মুখ নেই সা’দের!
কারণ তার অপরাধটাই ছিলো যে জঘন্য!
তনিমা রান্নাঘর থেকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই সা’দের মুখোমুখি পড়ে যায়!
সা’দ তখন মায়ের খুঁজে আসছিলো!
তনিমার চোখ নামিয়ে পাশ কেটে আসতে চাইলে সা’দের কিছু কথা শুনে থেমে যায়!
—মা এতো জোরে কেন মিউজিক বাজছে?
আমি কি বেরিয়ে যাব ঘর থেকে?
মা তোমাকে আমি কতো করে বলেছি ভাইয়াকে মানাও যাতে সে এই জঘন্য কাজটা না করে!
মিউজিকের শব্দ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যথা দিচ্ছে!
মিউজিকের শব্দে আমি শান্তিমত কোরআন তেলাওয়াত করতে পারছি না মনের শান্তিটাই উবে যাচ্ছে আমার!
শায়রা হোসেন বিরক্তি কন্ঠে বলেন,,
—তুই তোর ভাইকে গিয়ে শুনা এমন হাদিস!
আমি কি করবো? সে কি আমার কথা শুনে?
আমার ও মাথা ধরে যাচ্ছে!
সা’দ বিরক্তি নিয়ে ফিরে আসছিলো তনিমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার থেমে গেলো!
তনিমা চোখ ফিরিয়ে নিলো!
সা’দ তনিমার থেকে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে বললো,,
—সেদিনের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী!
আমি আমার ভুলের জন্য সত্যি অনুতপ্ত তনিমা!
তনিমা তাকালো সামনে থাকা সা’দের দিকে!
সা’দ মাথা নিচু করে ফেলেছে!
তনিমার মনে হলো সা’দ সত্যি অনুতপ্ত!
সে কিছু না বলে চলে যেতে চাইলে সা’দ আবার ও বলে উঠে,,
—আমাকে একটিবার বলো মাফ করে দিয়েছো প্লিজ?
আমি শান্তি পাচ্ছি না তনিমা!
আমার অপরাধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ভেতর থেকে!
আমি শান্তি পাচ্ছি না একদম!
সা’দের কন্ঠ ভারী হয়ে এলো!
তনিমা শান্তস্বরে বললো,,
— “অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অত:পর অনতিবিলম্বে তাওবা করে। এরাই হলো সেই সকল লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞাত। ” ( নিসা: ১৭)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে, পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা তওবা করে।”/রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক আদম সন্তান ত্রুটিশীল ও অপরাধী,
আর অপরাধীদের মধ্যে উত্তম লোক তারা যারা তওবা করে।”
[আহমাদ ১৩০৪৯, তিরমিযী ২৪৯৯, ইবনে মাজাহ ৪২৫১, দারেমী ২৭২৭, বাইহাক্বী ৭১২৭]
যেখানে আয়াত আর হাদীসের মাঝে আছে বান্দা তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তা মাফ করে দেন!
তাহলে বান্দা কেন মাফ করতে পারবে না?
আমি অবশ্যই আপনাকে মাফ করে দিয়েছি!
প্রত্যেকেই আমরা গুনাহগার!
কেউ বা আপনার মতো ভুল করে বড় ধরণের গুনাহ করে ফেলে কেউ বা ছোট্ট!
তবে আদম সন্তান গুনাহ করেই!
তাই বলে সে হতাশ হবে না!
আল্লাহ গুনাহ মাফের জন্য পথ ও বাতলে দিয়েছে!
তিনি সুসংবাদ দিয়েছেন তাওবাকারীর গুনাহ মাফ করেন বলে!
কিন্তু বারবার জেনেবুঝে একই গুনাহ করা সেটার মাফ আল্লাহ দিবেন কি না সেটা আল্লাহই জানেন!
সা’দ অস্পষ্ট সুরে বলল,,,
—আমি জানতাম সব তনিমা!
আমি জেনে বুঝেই……
—শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে গিয়েছিলেন তাই!
আল্লাহ বলেন,,,
” শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”
সে মানুষকে দিয়ে জিনা,ব্যভিচার করাতেই চাইবে সে তার সাথে মানুষকেও জাহান্নামে নিতে চাইবে!
কিন্তু আমরা মানুষ আল্লাহ আমাদের আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন!
আল্লাহ আমাদের কোনটা ভালো,কোনটা খারাপ কাজ তা ধারণা করার একটা সুস্থ মস্তিষ্ক ও দান করেছেন!
তারপর ও আমরা বান্দারা মস্তিষ্কটাকে শয়তানের প্ররোচনায় কাজে লাগাই!
আমরা ভাবি না,,আমাদের কাছে শয়তান শোভনীয় ভাবে তুলে ধরে হারাম কাজগুলো আর সেদিকেই আমরা আকৃষ্ট হয়ে ঝুকে পড়ি অজান্তেই শয়তানের ফাঁদে!
তাই আমাদের সবত্র সাবধান থাকা উচিত!
নিজের নফসের সাথে যুদ্ধ করেও আল্লাহর পথে ঠিকে থাকা উচিত!
আমাদের কষ্ট হবে কিন্তু আল্লাহ এর বিনিময়ে আমাদের উত্তম প্রতিদান দিবেন!
আল্লাহর ভয় দিলে গেঁথে নিলে খারাপ কথা ভাবতেই আত্মা কাঁপবে!
আমাদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা!
সবসময় ইস্তেগফফার করা!
তাহলে সহজেই শয়তান প্ররোচনা দিতে পারবে না!
আমি জানি আপনি তখন ভুলবশত কাজটি করতে যাচ্ছিলেন!
এখানে আমার ও যতেষ্ট দোষ ছিলো আমি জানি!
আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত দিক!
ফেতনা আমাদের কথার মাঝে সৃষ্টি হতে পারে সা’দ ভাইয়া!
সা’দ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তনিমার বলা প্রতিটা কথা শুনছিলো!
সা’দকে দ্বিতীয়বারের মতো ভাবাচ্ছিলো সে আসলে এতোদিন কি কি করেছিলো?
সত্যি সে বিমুখ ছিলো,,
অবাধ্য ছিলো,,
গাফেল ছিলো!
তার একটা সুস্থ মস্তিষ্ক থাকতেও সে ছিলো মস্তিষ্কহীন!
সে অকৃতজ্ঞ!
বড় অকৃতজ্ঞ!
সা’দ কাঁপা স্বরে বললো,,
—তুমি সেদিন খুব আঘাত পেয়েছিলে আমার ব্যবহারে তাই না তনিমা?
তনিমা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো!
সা’দ ও মুখ ফিরিয়ে রইলো!
বুকের ভেতর অজানা কষ্টের পাহাড় তুলছে সা’দের!
তনিমা ছোট্ট করে বললো,,
—চলি সা’দ ভাইয়া!
তনিমা আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো দ্রুত পদে নিজ রুমে চলে আসলো!
সা’দ কিছুক্ষণ দম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো!
তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করতে মাথা এদিক ওদিক করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো সে!
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তনিমার চোখ গেলো মাহতাবের দিকে!
হলুদ রঙ্গের পাঞ্জাবি পড়ে স্টেজের মধ্য হাসিমুখ নিয়ে বসে আছে আর তার সামনেই ফটোগ্রাফার বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলছে ভিডিও করছে!
একের পর এক হলুদ শাড়ি পড়া মেয়েরাও এগিয়ে যাচ্ছে ক্যামেরার সামনে!
মাহতাবের গাঁ ঘেষে বসে,,
একবাহুর সাথে আরেকবাহু মিলিয়ে ছবি তুলছে বিষয়টি মাহতাবকে উপভোগ করাচ্ছে বেশ মাহতাবের চেহারায় তৃপ্তির হাসি দেখেই বুঝতে পারলো তনিমা!
তনিমা দীর্ঘশ্বাস নেয়!
আল্লাহ যেন এদের সবাইকে হেদায়াত দান করেন!
মনে মনে সবার হেদায়াতের দোয়া করে নিলো তনিমা!
মাহতাবের হঠাৎ করেই চোখ যায় সিঁড়ির উপর!
তনিমা তড়িঘড়ি করে উপরে উঠে আসে! তনিমার সাথে মাহতাব আসার পর তেমন কথাই বলে নি,, দেশে এসে বন্ধুদের সাথেই রাত দিন আড্ডা দিতে বাহিরে থাকতো তনিমাকে সে ঠিকমতো খেয়ালই করে নি!
এতে তনিমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে কারণ মাহতাবের সামনে এভাবে বের হলে অবশ্যই একদফা কথা মাহতাবের থেকে শুনতে হতো!
মা-বাবা ও নুসাইবা নাহুরাকে দেখে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো তনিমার!
গেস্ট রুমে গোলাকার হয়ে অনেক মেয়েরা বসে আছে,গল্প-হাসি ঠাট্টা করছে!
তার মধ্যে মা-বাবাকে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসতে দেখতে পায় তনিমা!
মুখের নিক্বাবটা খুলে মাকে জড়িয়ে ধরে তনিমা!
রাবেয়া বেগম আনন্দে আটখানা হয়ে মেয়ের কপালে চুমো একে দেন!
বাবাকে সালাম জানিয়ে বাবার পাশে বসে তনিমা!
নসিব মিয়া মেয়ের বেশভূষার দিকে চোখ বুলিয়ে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকান কিন্তু মুখে কিছু বলেন না!
এর মাঝে নুসাইবা নাহুরাও কোথায় থেকে হৈ হৈ করে রুমে ঢুকে!
দুই বোনের দিকে হাসিমুখ নিয়ে তাকায় তনিমা!
নাহুরা ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল মেশায় কিন্তু নুসাইবা ফিরেও তাকায় না তনিমার দিকে!
বোনের এমন ব্যবহারে তনিমা মনে আঘাত পেলেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে!
হলুদ গাউন আর মাথায় হিজাব পরিহিতা এক মেয়ে উঁচু আওয়াজে এসে রুমে ঢুকে বলে,,,
—এখানে তনিমা আছে?
তনিমা হাসিমুখে বলে,,
–জ্বী!
—আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো আপনি এদিক দিয়ে আসবেন প্লিজ!
তনিমা এগিয়ে যায় সেই হলুদপরীটার দিকে!
মেয়েটি পরীর থেকে কম নয় নজরকাড়া সুন্দরী সাথে হলুদ কাপড়টাতে যেন তার সৌন্দর্য আর ও বাড়িয়ে তুলেছে!
তনিমা নিক্বাব টেনে বেড়িয়ে যেতে যেতে শুনতে পায় গুঞ্জন,,
—দেখ হিমা মেয়েটা কালি তার উপর নিজেকে কি ঢেকেঢুকেই না রাখছে মনে হচ্ছে তার দিকে সবাই তাকিয়ে থাকবে!
আমার তো মনে হয় কেউই ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না! আর কত্ত ঢং!
হিমা বলে উঠলো,,
—নিজেকে ক্যাটরিনা কাইফ মনে করছে!
পুরো রুমে হো হো শব্দে হাসির রুল পড়ে গেলো, তনিমার পা টা ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলেও আবার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হেটে চলে!
কিন্তু সেই হলুদ পরীটা থেমে যায় মাঝপথে!
সে আগের রাস্তায় আবার হেটে যায়!
তনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে দিকে!
মেয়েটি সেই রুমে যায় যে রুম থেকে অবজ্ঞাভরা কথা ভেসে এসেছিলো তনিমার জন্য!
তনিমাও এক পা দু পা করে এগিয়ে যায়!
মেয়েটি উঁচু আওয়াজে বলে,,,,
—আসসালামু আলাইকুম আপুরা কিছু কথা আপনাদের সাথে বলতে চাইছিলাম আপনাদের কি সময় হবে?
সবাই উৎসুক নয়নে মেয়েটির দিকে তাকায়,,তনিমাও তাকায়!
–আপনারা যাকে একটু আগে অবজ্ঞা করে যা বলছিলেন সে নিশ্চয়ই এই মেয়েটি?
মেয়েটি হাতের ইশারা তনিমার দিকে করলো!
তনিমা কাছুমাছু হয়ে দাঁড়ালো!
এই মুহূর্তে বেশ অস্বঃস্তি লাগছে তনিমার!
মেয়েটি বড়দের মতো মুখ করে বললো,,
—রাইট এই মেয়েটিই তাই না?
সবাই মাথা কাত করলো!
—একটা মেয়েকে আপনারা অবজ্ঞাসুরে কিছু বলে কি পেলেন?
বরং আপনাদের গুনাহটাই বেড়ে গেলো!
আপনারা সবাই মুসলিম ঘরের বোনেরা কিন্তু তারপর ও আমি আপনি অজ্ঞ!
কিন্তু এই মেয়েটা নিজের অজ্ঞতা দেখায় নি বলেই তাকে যা তা বলবেন?
আমি বলবো আপনারা এই মেয়েকে কটুক্তি করে নিজেদের মুখূর্তাই প্রকাশ করেছেন!
মেয়েটা কালো হতে পারে কিন্তু সে আমার আপনার থেকে অনেক সম্মানিত!
আমাদের মতো রাস্তার পণ্য নয় আপনি আমি নিজেকে রাস্তার পণ্য মনে করে যেভাবে মেলে ধরি সে সেভাবে পারে না কারণ সে নিজেকে ঝিনুকে মোড়ানো মুক্তা ভাবে বলে!
হিমা বলে উঠলো,,,
—এই মেয়ে তুমি কি বলতে চাইছো?
তোমার সাহস তো কম না সস্তা কাদের বলছো?
মেয়েটি অবজ্ঞাসূচক হেসে বলে,,,
—যারা এখানে অর্ধনগ্ন হয়ে এসেছে,,পিট গলা দেখিয়ে যারা ছেলেদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু মনে করছে তাদেরই সস্তা বলছি!
মেয়েটির কথা শুনে হিমাসহ যারা শাড়ি পড়েছে তারা অনেকেই শাড়ির আঁচল কাদের উপর তুলে নিলো!
মেয়েটি বললো,,
—জানেন পর্দা ফরজ?
তনিমা নিজের কালো দিকটা ভাবে নি, তার দিকে কেউ তাকাবে না সেটাও ভাবে নি সে শুধু ভেবেছে পর্দা ফরজ আর তাকে এটা করতেই হবে তার দিকে কেউ তাকাক বা না তাকাক!
আর যারা পর্দা করে না তারা তো নিজেকে সস্তা পণ্যই মনে করে তাই না?
যে যখন ইচ্ছে হলো পণ্যটি দেখে বা ছুঁয়ে তৃপ্তি মিটিয়ে নেয়!
তনিমা মেয়েটির হাত টেনে ধরে বলে,,,
—আপনি কি কথা বলবেন বলেছিলেন না?
—তনিমা তুমি আমাকে বাধা দিও না প্লিজ!
এদের জবাব না দিলে এরা থামবে না তোমাকে এভাবে কথার আঘাতে জর্জরিত করবে বার বার!
—কতো জনকে থামাবেন আপনি!
প্লিজ………
তনিমার করজোড় চাহনি দেখে মেয়েটি বেরিয়ে এলো রুম থেকে তনিমাও গেলো পেছন পেছন!
—আমার ভাইয়া সাইজানকে চেনো?
তনিমা সাইজানের নাম শুনেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলো!
সেই সাইজান যে সেদিন তনিমাকে খারাপ ভাবে……
আর এই মেয়েটি সাইজানের বোন!
মেয়েটি বললো,,
—আমার নাম এলিনা!
তুমি আমাকে এলি বলেই ডাকতে পারো!
ভাইয়া তোমার কথা আমাকে বললো আর যেহেতু মাহতাব ভাইয়া সাইজান ভাইয়ার ফ্রেন্ড সেহেতু আজ আসতে হলো!
ভাইয়ার কাছ থেকে শুনলাম তুমি এখানে আছো!
তাই দেখতে চলে এলাম!
ভাইয়ার পছন্দ আছে বটে মাশা’আল্লাহ তোমার চেহারা একদম মায়াবতীদের মতো!
তনিমা বিস্ফারিত হয় এলিনার কথা শুনে!
পছন্দ এসব কি?
তনিমা ভাবে!
তখনি সামনে কেউ এসে দাঁড়ায়!
তনিমা সামনে তাকাতেই আরো বড় ধাক্কা খায়!
তার সামনে সাইজান দাঁড়িয়ে!
এলিনা চোখের ইশারা তনিমাকে দেখায়!
সাইজান বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে যায়!
তনিমার মাথায় কুলায় না!
সে কেমন সাইজানকে এখন দেখলো?
সেই বখাটে সাইজান আর এখনকার সাইজানের মধ্যে বিস্তর ফারাক!
সাইজান মুষ্টি দাড়ি রেখেছে!
টাকনুর উপর প্যান্ট আর হালকা ছাই রঙ্গের টিশার্ট পড়েছে!
সাইজানকে মাহতাবের সঙ্গে কথা বলতে দেখে তনিমা!
সে এভাবে তাকাচ্ছে কেন?
চোখ ফিরিয়ে নেয় তনিমা!
এলিনা কিছুক্ষণ তনিমার দিকে তাকিয়ে হাসে!
তনিমা কাঁপা কন্ঠে বলে,,
—আ……আপনি সাইজান ভাইয়ার বোন?
উ……নি সাইজান ভাইয়া?
এলিনা ভ্রু জোরা ভাজ করে আবার ছাড়ে!
তনিমা অবাক হয়ে তাকায় এলিনার দিকে!
এলিনা তনিমার হাত ধরে বলে,,,
—আমি একজন পারফেক্ট ভাবি পাচ্ছি তাহলে আলহামদুলিল্লাহ!
তনিমা এলিনার দিকে অবুঝ হয়ে তাকিয়ে থাকে!
এলিনার কোন কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না!
—মা আমি যদি বলি তনিমা এ বাড়িতে পার্মানেন্টলি থাকুক! তুমি কি কোন আপত্তি করবে?
রান্নাঘরে এসে মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে কথাটি বলে সা’দ!
সা’দের কান মুলিয়ে বলেন শায়রা হোসেন,,
—ওরে আমার পাকনা বুড়ো রে তা এতোদিনে বুঝি সুবুদ্ধি হলো?
সা’দ মায়ের হাত কান থেকে ছাড়িয়ে মুচকি হাসে!
শায়রা হোসেন তৃপ্তি নিয়ে বলেন,,
—তোকে আমি মানুষ করতে পেরেছি আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া!
এখনকার যুগের ছেলেরা ফর্সা রঙ ছাড়া কারো দিকে চোখ তুলেই তাকায় না আর সেই জায়গায় তুই তনিমার মতো মেয়েকে পছন্দ করেছিস!
সত্যি বলছি বাবা তনিমার মতো এতো বিনয়ী একটা মেয়েকে আমি ছাড়তে চাই না!
সা’দ মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,,
—তাহলে দোয়া করো মা!
তোমার ছেলেটা যাতে আরো বেশি মানুষ হতে পারে!
তোমার ছেলেটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শয়তান এখনো খেলে
তনিমা হয়তো আমার ভালো পথের উসিলা হতে পারে মা!
শায়রা হোসেন কিঞ্চিত হাসেন!
বিছানায় এক বার বসে আবার দাঁড়িয়ে পড়ছে তনিমা!
পুরো শরীর কাঁপছে তনিমার!
কি শুনছে আর কি হচ্ছে কিছুই ঠিক ধরতে পারছে না তনিমা!
রাবেয়া বেগম মেয়েকে একটু আগে বলে গেলেন সাইজান না কি তনিমাকে পছন্দ করে!
তাই তারা কথা এগুতো চায়!
তনিমার বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটে নি!
এর মাঝে শায়রা হোসেন হাসিমুখে রুমে ঢুকেন!
তনিমা স্থির হয়ে দাঁড়ায়!
শায়রা হোসেন বেশ আহ্লাদী সুরেই তনিমার সাথে কথা বলতে থাকেন!
আর ওপরপাশে নিজ রুমে সিজদায় পড়ে নিজের আকুতি প্রকাশ করতে থাকে সা’দ!
রাবেয়া বেগম এক্ষুণি পারেন তো তনিমাকে সাইজানের হাতে তুলে দেন!
তনিমাতো একধরণের বুঝা তাদের কাছে!
মেয়েকে নিয়ে এতোদিন ভীষণ চিন্তিত ছিলেন কে তাকে বিয়ে করবে বা ভালো ঘরে আদৌ বিয়ে দিতে পারবেন কি না?
কিন্তু এভাবে অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব তা ও এতো বড় ঘর থেকে পাবেন বলে আশা করেন নি রাবেয়া বেগম!
এ যেন না চাইতেই আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন!
স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন রাবেয়া বেগম!
এখন মাহতাবের বিয়েটা হয়ে গেলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ব্যবস্থা করে ফেলা যাবে!
তনিমা মাকে একলা একলা মুচকি হাসতে দেখে অবাক হয়!
রাবেয়া বেগম বলেনন,,
—এতোদিন পর এতো ভালো একটা প্রস্তাব এলো!
সাইজান ছেলেটা তো অসম্ভব ভালো!
আর ওর কতো বড়লোক!
আল্লাহ আমার মেয়েটাকে দয়া করেছেন!
তনিমা দীর্ঘশ্বাস নেয়!
তাহলে মায়ের খুশির কারণ এই……!
সকাল হতেই সবাই সাজগোজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে!
কেউ কেউ এতক্ষণে পার্লারেও চলে গিয়েছে!
আর যারা যেতে পারে নি তারা ঘরেই সাজগোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে,,,ছোট থেকে বুড়ো কেউই যেন বাদ যাচ্ছে না!
কার থেকে কে বেশি সাজতে পারে সেই প্রতিযোগিতাই যেন লেগে গিয়েছে!
তনিমার মনে হচ্ছে বিশ্বসুন্দরী সিলেক্ট করা হবে আর তারই প্রতিযোগীতা হচ্ছে!
তার মধ্যে এক ভদ্র মহিলাকে দেখে তনিমা থমকে গেলো!
ভদ্র মহিলাটি আর কেউই নয় তারই জন্মদাত্রী মা!
তনিমা মুগ্ধ হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো!
মাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি মাত্র যৌবনে পা রেখেছেন
এতোটা ঝমকালো ভাবে সেজেছেন রাবেয়া বেগম!
ভাইপোর বিয়ে বলে কথা।
রাবেয়া বেগম হালকা সবুজ কালারের কাতান শাড়ি পড়েছেন তার সাথে ম্যাচিং করা কানের ঝুমকো গলায় হালকা স্লিভলেস পাথরের গহনা,
গহনাটা দেখে তনিমার মনে হলো এটা বড় বোন নুসাইবার,হাতে আবার সোনার বালা,ম্যাচিং জুতো!
তার উপর গোল্ডেন কালারের হিজাব ও পড়ছেন মেঝ বোন নাহুরাই মাকে সাজিয়ে দিচ্ছে!
মায়ের এমন কান্ড দেখে তনিমা কি বলবে কুল পাচ্ছে না!
রাবেয়া বেগমের হঠাৎ করেই তনিমার দিকে চোখ গেলো!
তনিমা তখন বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো!
তিনি আওয়াজ দিয়ে তনিমাকে ধমক দিলেন,,
—এই এভাবে বসে আছিস কেন রেডি হবি না?
অনুষ্ঠানে যাবি না?
—মা তুমি এভাবে সাজছো কেন?
রাবেয়া বেগম মেয়ের প্রশ্নে বিমোহিত হোন!
তিনি আনন্দে আপ্লুত হয়ে মেয়েকে প্রশ্ন করেন,,,
—কেন রে সুন্দর লাগছে না বুঝি?
কতোদিন পর সাজলাম!
সেই যে বিয়ের দিন আর এইভাবে কখনোই সাজা হয় নি!
তনিমা মৃদু পায়ে মায়ের কাছে যায়!
রাবেয়া বেগম শাড়ির আঁচল কাদে তুলে ঠিক করতে থাকেন!
তনিমা কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,
—মা তুমি জানো তোমাকে এখন পুরো একটা যুবতী লাগছে!
সুন্দর লাগছে কিন্তু মা এইভাবে সাজা কি ঠিক?
এভাবে সেজে নিজেকে প্রদর্শন করা মানে জাহেলি যুগের মেয়েদের পরিচয় দেওয়া!
আল্লাহ তাই কোরআনুল কারীমে বলেন,,,
‘তোমরা ঘরে অবস্থান করো এবং পূর্ববর্তী জাহেলি (বর্বর) যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না। ’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৩)
চুলের খোঁপা ঠিক করছিলো নাহুরা!
বোনের কথা অনেকক্ষণ ধরেই শুনতে পাচ্ছিলো কিন্তু কিছু বলছিলো না!
এইবার বেশ ধমকেই তনিমাকে বললো নাহুরা,,
—এই যে আপনার যদি যাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে আপনি রেডি হোন!
নইলে এখানে থেকে যান!
নইলে এখন পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে যাবে আপনার গালে!
তনিমা বোনের ধমকে চুপ হয়ে যায়!
রাবেয়া বেগম আহ্লাদী স্বরে বলেন,,
—তুই রেডি হো যা!
—আমি যাব না মা!
আর কিছু না বলেই তনিমার গমগম পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে শান্তির নিঃশ্বাস নেয়!
রাবেয়া বেগম ও পিছুপিছু আসেন মেয়ের!
তনিমা মায়ের দিকে উদাস হয়ে তাকায়!
রাবেয়া বেগম বলেন,,
—একদিনই তো রে মা!
—মা একদিন?
একদিনে কতো পাপের ভার মাথার উপর আসবে!
মা তুমি সবসময় বোরকা পড়ো তাহলে আজ কেন এভাবে মা?
আপুদের পাল্লায় পড়ে নিজের আখিরাতের কথা ভুলে যাচ্ছ!
মা বেপর্দার পরিণাম নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়!
আর আপুদের ও বুঝাও মা এসব কি করছে আপুরা!
ওরা না মাদ্রাসায় পড়ে!
হাদিস-কোরআন সবই তো ভালোভাবেই বোধগম্য ওদের!
আমার মতো তো অশিক্ষিতা অজ্ঞ নয়!
তনিমার শেষের কথাগুলোতে রাগ ঝড়ে পড়ছিলো!
মা-বোনদের এমন অবস্থা তনিমার খারাপ লাগছিলো ভীষণ তার উপর সবার সামনে নাহুরার কথাগুলো প্রচন্ড রকমের কষ্ট দেয় তনিমার মনে!
বুক জ্বালার সাথে চোখ ও জ্বলছে তনিমার!
নসিব মিয়া কোথা থেকে হতদ্বন্দ হয়ে তনিমার সামনে আসেন!
রাবেয়া বেগম কিছুটা ভয় পান!
নসিব মিয়া যদি এভাবে দেখেন নিশ্চয়ই কিছু বলবেন!
ইশ! যদি এখুনি বের হওয়া যেত তাহলে সবার সামনে কিছুই বলতে পারতেন না হয়তো!
রাবেয়া বেগম ঘামতে থাকেন!
নিশ্চয়ইই একজন ইমাম,দাড়ি জোব্বাওয়ালার বউ এভাবে নিজেকে প্রদর্শন করুক নিশ্চয়ইই মেনে নিবেন না,,ভাবেন রাবেয়া বেগম!
—তনিমা তোর মা কোথায়!
ওকে দেখছি না যে!
বাবার কথায় তনিমা বড়সড় ধাক্কা খায়!
তনিমা ঘাড় ঘুরায়!
পাশেই তো মা দাঁড়িয়ে তাহলে বাবা এভাবে প্রশ্ন করছেন কেন?
মা কে কি চিনতে পারছেন না আশ্চর্য?
নসিব মিয়া মেয়ের থেকে উত্তরের আশা না করে এদিক ওদিক তাকিয়েও ব্যর্থ হোন!
তনিমা ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকে!
রাবেয়া বেগম এক পা দু পা করে পেছাতে থাকেন এখান থেকে কেটে পড়লেই বাঁচেন তিনি!
—কি রে দেখেছিস তোর মাকে?
সাইজান খোঁজছিলো!
“সাইজান” নামটা শুনে থমকালো তনিমা!
তারপরইই হাতের দ্বারা ডানদিকে ইশারা করলো!
নসিব মিয়ে মেয়ের ইশারাকৃত লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে নেন!
রাবেয়া বেগমের আর এখান থেকে সরা সম্ভব হয় নি তার আগেই নসিব মিয়ার চোখে পড়ে যান!
নসিব মিয়া গম্ভীর গলায় চাপা স্বরে বলেনন,,,
—এতো এতো মানুষের সামনে যদি আমার হাতের চড় না খেতে চাও তো চুপচাপ গিয়ে বোরকা পড়ে নাও!
তনিমা মায়ের দিকে তাকায়!
রাবেয়া বেগমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মুহূর্তেই!
বড় আনন্দ নিয়ে সেজেছিলেন তিনি!
মায়ের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসে তনিমা!
সাইজান এদিক ওদিক তাকিয়ে তনিমাকে খুঁজতে থাকে কিন্তু দেখতে পায় না!
সবাই কমিউনিটি সেন্টারে বেরিয়ে যাচ্ছে!
কিন্তু তনিমা বের হচ্ছে না!
এলিনা ভাইয়ের কুনুই হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,,
–কি ভাইয়া ভাবিকে খুঁজছিলে বুঝি?
সাইজান বোকাটে হাসে!
এলিনা বলে,,,
—বাহ রে! তুমি না মেয়েদের দিকে তাকাও না?
সাইজান উত্তরে রহস্যভরা হাসি হাসে!
এলিনা ও হাসে!
—বল ওকে তুই দেখেছিস কি?
—হু দেখেছি তো ওই ঘরে!
এলিনা হাতের ইশারায় ভাইকে কর্ণারের রুমটি দেখিয়ে দেয়!
তথাস্তু সেদিকে এগিয়ে যায় সাইজান!
—আপু তোমাকে ভারী সুন্দর লাগছে!
তনিমার কথায় নুসাইবা হাসে!
আসার পর থেকে তনিমার সাথে কথা না বললেও এখন বেশ বলতে ইচ্ছে হলো নুসাইবার!
কারণ নুসাইবার তাকে অনেক ভালো লাগে যে তার প্রশংসা করে!
নুসাইবার মনে হয় তনিমাকে সাজিয়ে দেওয়া দরকার!
নুসাইবা বলে,,,
—আয় তনিমা তোকে আমি সাজিয়ে দেই!
তনিমা বাধা দেয়!
সে বলে,,
—আপি কিছু মনে করো না!
তোমাকে এই গর্জিয়াছ পোশাকে ভালো লাগছে,সুন্দর দেখাচ্ছে ঠিকই কিন্তু আপু তোমার এই সৌন্দর্য কি যত্রতত্র দেখিয়ে বেড়ানোর কথা?
আপু গো তুমি তো সব জানো!
আর বাবা দেখলে তো রাগ করবে ভীষণ!
নুসাইবার হাসি হাসি মুখটা মিইয়ে যায়!
সে বোনকে সাজিয়ে দিতে চেয়েছিলো,,,,
মেকাপ দিয়ে তনিমার কালো রংটা ঢেকে দিতে চেয়েছিলো নুসাইবার!
কিন্তু তনিমার এখনকার কথায় তনিমাকে সাজিয়ে দেওয়ার কথা দূরে থাক তনিমার মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার!
নিজের রাগকে সংযত করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো নুসাইবা,,,
—আসলে কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না!
তেমনি তোর!
ভাবছিলাম তোকে সাজিয়ে দিয়ে তোর কালো রংটা ক্ষণিকের জন্য ঢেকে দিবো,,
কিন্তু ওই যে কথায় আছে না হজম হয় না?
তেমনি তোর!
তোর ভালোটা হজম হয়!
তুই যেমন আনকালচারড,,ক্ষ্যাত,,ঘ্যাওয়া আছিস তেমনি সারাজীবন থাকবি তোর উন্নতি হবে না!
—-তনিমা উন্নতি না হোক!
তোমাদের হবে তো?
পেছন থেকে ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে তনিমা নুসাইবা হকচকিয়ে গেলো!
তনিমা দ্রুত নিজের উপর পর্দা টেনে দিলো!
সাইজান দরজায় দাঁড়িয়েইই বলতে লাগলো,,
—তো নুসাইবা কি বলছিলা তনিমা ক্ষ্যাত ঘেও আর কি কি যেন?
নুসাইবা সাইজানকে দেখে কথা হারিয়ে ফেললো!
সাইজান তার সেই কিশোরীকালের ক্রাশবয়!
কিন্তু সাইজানের সাথে কথা বলা বা তার সামনে পড়ার কোন সুযোগ হয়ে উঠে নি!
তাই আজ আচমকা সাইজানের এমন এন্ট্রিতে নুসাইবাকে হতচকিত করলো!
—তনিমা তুমি নিশ্চয়ইই এতক্ষণে জেনে গেছো তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে!
ইন শা আল্লাহ খুব দ্রুতই তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবে!
আর আমার হবু বউকে কেউ অপমান করুক সেটা আমি নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো না!
কথাগুলো নুসাইবার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো সাইজান!
তনিমা নুসাইবাকে মৃদু সুরে বললো,,
—আপু এখান থেকে বের হই চলো!
নুসাইবা তনিমার দিকে একবার সাইজান দিকে একবার তাকালো!
তনিমার সাথে সাইজানের মতো এতো স্মার্ট ছেলের……
নুসাইবার হজম করতে কষ্ট হলো!
সাইজান আবারো বললো,,
—তনিমা এই দুনিয়ার জন্য এই দুনিয়ার মানুষদের কাছে সে আনকালচারড,ক্ষ্যাত হতে পারে কিন্তু সে ইন শা আল্লাহ, আল্লাহর কাছে সম্মানিত!
তনিমা চাইলেই তোমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে এভাবে ঘুরতে পারতো কিন্তু আল্লাহর ভয়ে সে তা করে নি!
কারণ সে জানে এই ক্ষণিকের দুনিয়া থেকে উত্তম দুনিয়া তো আখিরাত!
সেই দুনিয়ার কোন সমাপ্তি নেই!
সেই দুনিয়ায় সুখ লিখা থাকলে চিরজীবন তা উপভোগ করবে তাকে আল্লাহ তা’য়ালা এর প্রতিদানে ইন শা আল্লাহ আখিরাতে চিরস্থায়ী বাসস্থান জান্নাতে জায়গা দিবেন!
কারণ আল্লাহর জন্য যা কিছু ত্যাগ করা হয় আল্লাহ তার থেকে তাকে উত্তম কিছু দান করেন!
গট ইট!
নুসাইবা দম ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে!
সাইজান তনিমার দিকে একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুড়ে বেরিয়ে যায়!
এসেছিলো তনিমার সাথে কিছু জরুরী কথা বলতে!
কিন্তু মেজাজটাই তো খারাপ হয়ে গেলো!
নুসাইবা অস্পষ্ট স্বরে বোনকে বলে,,
—তনিমা সাইজানের সাথেই তোর বিয়ের কথা……
তনিমা মাথা নিচু করে নেয়!
নুসাইবা যা বুঝার বুঝে নেয়!
দু হাত দিয়ে লেহেঙ্গার দু পাশে ধরে টাকুনি অব্ধি লেহেঙ্গা উঠিয়ে একপ্রকার দৌড়েই রুম থেকেই বের হয়ে যায় নুসাইবা!
তনিমা বোনের আচমকা দৌড়ে অবাক হয়!
সুন্দরমতো হাতের ঘড়িটা পড়ে নেয় সা’দ উদ্দেশ্য তনিমাদের বাড়ি!
সব ঠিক থাকলে আজই আক্দটা করে নিবেন শায়রা হোসেনের ভাবনা এমনই!
সা’দ ভেতর ভেতর ভারী খুশি!
শায়রা হোসেন তনিমাদের বাড়ির কাউকেই জানান নি যে তারা আজ আসছে!
হুট করেই সবাইকে চমকে দিতে চান তিনি!
আর তনিমার বিষয়ে এমন প্রস্তাব শুনে নিশ্চয়ই নাকুচ করবেন না নসিব মিয়া এটা শায়রা হোসেনের বিঃশ্বাস!
তনিমাকে আজ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে!
আজ তনিমাকে সাইজানদের বাড়ি থেকে সাইজানের মা-বাবা দেখতে আসবে!
নিজেকে সাজাতে তনিমা বাধা দিলেও রাবেয়া বেগম জোর করেই মুখে পাউডার লেপ্টে দেন কিছু তনিমার!
উনার কথা যদি তনিমাকে দেখে তারা ফিরে যায়!
শত অপেক্ষার পর এমন প্রস্তাব এসেছে!
কোন কমতি হোক এটা রাবেয়া বেগম চান না!
—তোর কি কপাল রে তনিমা সাইজানের মতো এতো হ্যান্ডসাম ছেলে পাচ্ছিস!
নুসাইবার গলা শুনে তনিমার মুখ কালো মেঘে ডেকে গেলো!
এই সাইজানকে সে মানতে পারছে না!
সাইজানের ভালো চেহারাটা তনিমার একদম ভালো ঠেকছে না!
হঠাৎ করেই সাইজানের এমন পরিবর্তন তনিমার মনের খুচখুচানি যেন বেড়ে চলছে!
—তা সাইজান তোকে কি দেখে পছন্দ করলো রে তনিমা?
ও তো আমাকেও পছন্দ করলে করতে পারতো!
তোর থেকে তো কম সুন্দর নই আমি!
এমনিতেই বিরক্ত লাগছে তনিমার তার উপর বোনের এমন কথায় মেজাজ খিঁচে যাচ্ছে!
গায়ের রঙ নিয়ে খুঁচা না মারলেই যেন নয় এদের!
—আপু তুমি তাহলে সাইজান ভাইয়াকে বিয়ে করে নাও!
আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই নেই!
তনিমার কথা বিস্মিত হয় নুসাইবা!
সে তনিমার গলায় কপালে হাত রেখে দ্রুত বলে,,
—তোর কি মাথা ঠিক আছে!
সাইজান কে রিজেক্ট করতে চাইছিস!
তোর কপাল ভালো তুই যে এমন ছেলে পাচ্ছিস!
—তোমার তো কষ্ট হচ্ছে আপু তাই বলছিলাম!
আমি না ই করলাম এই বিয়ে!
বোনের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে গাড়ির হর্ন শুনে নুসাইবা সেদিকে এগিয়ে গেলো!
তনিমা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বেরর দিকে উদাসীনা হয়ে তাকিয়ে রইলো……
আমি পাপী গুনাহগার!
তুমি ছাড়া কে আছে আর!
ক্ষমা করো হে প্রভু তাওবা করি বারেবার……
ইয়া রাহিমু ইয়া রহমান!
ইয়া কারিমু,,,মেহরবান!
মোবাইলে গজলটি প্লে করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে তনিমা,,,চোখ দিয়ে অঝর ধারায় জল ঝরছে তার!
একটু আগের কাহিনী……
তনিমা বসে আছে সাইজানের মা ও সাইজানের সামনে!
আবায়া আর হিজাব আবৃত দেহে তনিমার আসল সৌন্দর্য বেরিয়ে পড়েছে!
স্নিগ্ন ও পবিত্র দেখাচ্ছিলো তনিমাকে!
ওদের সামনে আসার আগে তনিমা ওযু করে দু রাকাত নফল নামায পড়ে নিয়েছে!
কেন জানি মনে হচ্ছিলো কিছু ঠিক হচ্ছে না,,মনটা অশান্ত হয়ে উঠছিলো বারেবার তনিমার!
তাই দু রাকাত নামায পড়েই কিছুটা শান্তি এলো মনে তনিমার!
পান চিবুতে চিবুতে সাইজানের মা প্রশ্ন করলেন তনিমাকে……
—তা মেয়ে কতখানি পড়ছো?
তনিমা কাছুমাছু হয়ে বললো,,
—ক্লাস নাইনে এডমিশন নিয়েছি!
—ওওও আইচ্ছা!
মাইয়াগো এতো পড়নের দরকার ও নাই!
তো রান্নাবন্না জানো না কি?
তনিমা ছোট্ট করে উত্তর দিলো,,
—জ্বী!
—আইচ্ছা হাটি দেখাও তো!
তনিমা এবার চুপ হয়ে বসে রইলো!
রাবেয়া বেগম এসে মেয়ের বাহু ধরে উঠালেন বসা থেকে এক পা দু পা মেয়েকে হাটিয়ে আবার বসিয়ে দিলেন!
মুখের পানের রস তনিমাদের সোফার পাশেই ফিক করে ফেলে দিয়ে মহিলাটি আবার তনিমার দিকে তাকালো!
তনিমার ঘা ঘিনঘিন করছে!
—পুলার লাগি আইছি তোমারে দেখতে
নইলে আইতাম ই না!
গায়ের রংটা তো মোটেই নাই,,,পুলাটা কি দেইখা যে পছন করলো!
এই বলে মহিলা বিড়বিড় করতে লাগলেন!
তনিমার চুপসে গেলো!
মায়ের এতো পাউডার ও তনিমার কালো রংটা ঢাকতে পারলো না!
—রূপ তো নাই ই!
চুলটা খুলি দাও তো!
দেখি চুল টুল আছে নি!
তনিমা এবার বসা থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো!
মহিলাটি বড় বড় চোখে তনিমার দিকে তাকিয়ে রইলো!
চুল সে কিছুতেই দেখাবে না মনস্থির করে নিলো তনিমা!
সে পণ্য না কি এভাবে নিজেকে খুলে খুলে দেখাবে আশ্চর্য?
কালো হওয়ায় কি পাপ করলাম না কি!
তনিমা মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে নেয়!
অবস্থা বেগতিক দেখে সাইজান এবার মুখ খুলে!
এতোক্ষণ মুখে কুলুপ এটে বসে ছিলো সে!
—আহা মা! বাদ দাও না!
এভাবে দেখা ইসলামে জায়েজ নাই!
—হু আইসে আমার ইসলামি!
বাবা তুই কবে থাকি ইসলামি হইলো!
—আহা মা……
সাইজানের মা এবার চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন!
তারপর বললেন,,
—আচ্ছা তুমি ঘরে যাও!
তনিমা গটগট করে নিজের রুমে চলে আসলো!
এতক্ষণ কিভাবে যে বসে ছিলো তনিমা নিজেও জানে না!
সাইজানের বিষয়টি ভাবাচ্ছে বারবার!
সাইজান কি সত্যি পালটে গেছে!
সাইজান তো ঠিক তেমনি যেমনটা সে চেয়েছে!
তাহলে কেন এতো দ্বীধা কাজ করছে!
আল্লাহ সাইজান যদি আমার জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে তাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে দিও!
—আসতে পারি!
আকাশের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে ছিলো তনিমা!
ভারী কণ্ঠস্বর শুনে ঘার ঘুরাতেই সাইজানকে দেখে চমকে গেলো তনিমা!
সাইজান মুচকি হেসে তনিমার বিছানায় বসলো!
তনিমা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো!
সাইজান তা দেখে বাধা দিয়ে বললো,,,
—উহু তনিমা তোমার সাথে তো আমার বিয়ে হচ্ছেই!
এখন মুখ ডাকছো কেন?
—দেখুন আপনার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে ঠিক কিন্তু এখনো হয়ে যায় নি!
আর আমি ইস্তেখারা করবো,
যদি মন সায় দেয় তাহলেই ইন শা আল্লাহ বিয়েটা হবে নাহলে নয়!
প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তনিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সাইজান!
মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো তনিমার চোখের দিকে!
তনিমা চোখ নামিয়ে বললো,,,
—দেখুন এভাবে আপনার এখানে আসা ঠিক হয় নি?
—আচ্ছা কিরকম ঠিক হয় নি!
মুরব্বীরাই আমাদের এই সুযোগ করে দিয়েছেন!
নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে নিতে!
তনিমা কিড়মিড় করে বললো,,,
—এই ট্রেন্ডটা কে চালু করেছে জানি না!
বিয়ের আগে নির্জনে কোন যুবক যুবতি একসাথে মিলিত হলে তার তৃতীয় জন হয় শয়তান!
আর শয়তান মানুষকে বিপথে চালিয়ে দিতে পারে!
হ্যাঁ আলাপ করা যায় কিন্তু এভাবে একা গায়রে মাহরাম যুবক যুবতি নয় সাথে মাহরাম অবশ্যই থাকা প্রয়োজন!
আপনি যান প্লিজ এখন!
তনিমা একথা বলেই সাইজানের পাশ দিয়ে চলে আসতে নিলে সাইজান তনিমার হাত হেচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে!
সাইজান টান দেওয়ার ফলে তনিমার মুখে ওড়নাটাও সরে যায় মুখ থেকে!
সাইজান শক্ত করে তনিমার হাত ধরে মুচকি হেসে বলে,,
—দেখো তনিমা তোমাকে আমি পছন্দ করি আর বিয়েটাও হবে!
এভাবে লুকোচুরি করে থাকার মানেই হয় না!
তনিমা হাত ছুটানোর চেষ্টা করলেও পেরে উঠে না সাইজানের শক্তির কাছে!
—আরে মোচড়ামুচড়ি করে পারবে না তো ছাড়াতে!
—আপনাকে আমি এতোক্ষণ কি বলেছিলাম?
আমাদের বিয়েটা এখনো হয় নি……
দাঁতে দাঁত চেপে বলে তনিমা!
সাইজান তনিমার হাতসহ বাহু চেপে ধরে!
পুরো শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠে তনিমার!
সাইজান বিশ্রীভাবে তনিমার দিকে তাকায়!
তনিমার মনে হয় এই সাইজান সেই বখাটে সাইজান!
যে প্রথমদিন তার সাথে বিশ্রীভাবে একই আচরণ করেছে!
তনিমা আল্লাহর কাছে সাহায্য চায় মনে মনে!
সাইজান তনিমার একদম কাছে এগিয়ে গিয়ে……
নুসাইবা হুট করে এসে তখন ঘরে ঢুকে যায়!
বোনকে এমন আপত্তিকর পরিস্থিতিতে দেখবে নুসাইবা ভাবে নি!
আর তার পছন্দের মানুষটাও এভাবে……
নুসাইবার চোখ লাল হয়ে উঠে!
সাইজান কারো পায়ের আওয়াজ শুনেই ঝট করে ঘাড় ঘুরায়!
তনিমা সেই সুযোগে ধাক্কা দিয়ে সাইজানকে দূরে ঠেলে দেয়!
পুরো শরীরে কাঁপুনিতে তনিমা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না!
ধপাস করে মাটিতে বসে যায় তনিমা!
সাইজান নুসাইবার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ!
নুসাইবা এগিয়ে যায় সাইজানের দিকে!
চোখ নামিয়ে চলে যেতে নেয় সাইজান!
নুসাইবা ঠাশ করে তখনি সাইজানের গালে চড় বসিয়ে দেয়!
তনিমার গাল বেয়ে পানি উপচে পড়ছে!
ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ উচ্চস্বরে হচ্ছে!
সাইজান এই রূপটি তনিমার কাছে পরিচিত হলেও সেদিনের সাইজানকে দেখে সেই বখাটে রূপটির কথা ভুলে গিয়েছিলো তনিমা!
মনে হয়েছিলো সাইজান সত্যি পালটে গেছে!
না সাইজান পালটায় নি,,
সে শুধু নেক সুরতে শয়তান হয়ে এসেছে!
আর সেই শয়তানি সুরত তনিমাকে একা পেয়ে বেরিয়ে এসেছে!
নুসাইবার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় সাইজান!
সাইজানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বোনের দিকে এগিয়ে যায় নুসাইবা!
বোনের পাশে মাটিতে বসে মাথায় হাত রাখে সে!
বড় বোনকে পাশে পেয়ে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তনিমা!
সাইজান দ্রুত পায়ে ঘর ছাড়ে!
ব্যাপরটি এতো দ্রুত ঘটে যাবে সাইজান ভাবে নি!
পুড়নো অভ্যাসটা এভাবে তনিমাকে একা পেয়ে মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছিলো যেন!
নিজের খারাপ চরিত্রটা এভাবে প্রকাশ পেয়ে যাবে সাইজান ভাবে নি!
সে ভেবেছিলো তনিমাকে বিয়ে করার পর আসল রূপটা দেখাবে আর তনিমার দেমাগটা ভেঙ্গে দিবে,,,জ্বালিয়ে মারতে চেয়েছিলো তনিমাকে সে!
কিন্তু তনিমা তো আল্লাহর কাছে মন থেকে সাহায্য চেয়েছে!
তনিমার কি বিপদ হতে পারে?
তনিমা ডুকরে কাঁদছে!
নুসাইবার ও কান্না পাচ্ছে!
যে তনিমাকে সে দেখতে পারতো না আজ সেই তনিমার জন্য কান্না পাচ্ছে তার!
তার বোনটি তো ফুলের মতো!
এতোকিছু হয়তো বুঝেও না!
সাইজানের সাথে এমন আপত্তিকর কিছু ঘটবে বোনটি হয়তো বুঝতেও পারে নি,,,,!
—আ……আপু আ…আমায় তোমরা ও…ওর কাছে বিয়ে দিও না!
আ……আমি ওকে বিয়ে করবো না আপু!
ও খুব বাজে লোক আপু ও খুব বাজে লোক!
আ…আপু আ…আমি তোমা…দের সব কাজ করে দিবো আ…আমি ঘরের সব কাজ করবো আ…আমাকে কাজের মেয়ে ভেবেই ঘরে রেখে দাও আপু!
আমার কালো রংটার জন্য তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দিও না আপু!
আ…আপু আমার গায়ের রঙ কালো এটাতে তো আমার দোষ নেই আপু!
আল্লাহই আমাকে এই রংটা দিয়েছেন আপু!
আ…আপু মাকে বলোনা আমাকে ওই বাজে লোকটার সাথে বিয়ে না দিতে!
বোনকে শক্ত করে আঁকড়ে রাখে নুসাইবা!
বোনটা তার বড্ড কষ্ট পাচ্ছে!
কিভাবে নিজের এই পিচ্চি বোনকে গায়ের রংয়ের জন্যই দিনের পর দিন খোঁটা দিতে পারলো!
ওরই তো বোন সে!
নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হয় নুসাইবা!
তনিমাকে কাঁদতে দেখে পাশে থাকা নুসাইবা বললো,
—এভাবে কাঁদিস না তো!
আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানা ওই বাজে লোকটার আসল রূপ বেড়িয়ে এসেছে!
উঠ খেতে চল আয়!
তনিমা চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসলো!
—মা-বাবা এখনো মন খারাপ করে আছে না আপু ওদের ফিরিয়ে দেওয়ায়?
ভারী গলায় প্রশ্ন করলো তনিমা!
নুসাইবা চোখে মুখে বিরক্তির আভা ফুটিয়ে বললো,,,
—বেশ করেছি ওদের ফিরিয়ে দিয়ে!
মা-বাবা থাকুক মন খারাপ করে!
ওরা তো আর দেখেনি সাইজানের রূপ!
আমার বোনকে আমি জাহান্নামের গর্তে ঠেলে দিতে পারি না!
তনিমা বোনের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকালো!
সে সত্যিকারে তার সেই রাগী বোনটাকে ফিরে পেয়েছে!
যে এখন তাকে একজন বোনের মতোই প্রটেক্ট করছে!
তনিমা মৃদু হাসে!
—তাহলে ভাই সাহেব আগামী শুক্রবার বরযাত্রী নিয়ে এসে আপনার মেয়েকে নিয়ে যাব!
তনিমা লজ্জায় কুঁকড়ে যায়!
এই একটু আগে সা’দ ও তনিমার আক্দ হয়ে গেলো!
সা’দের ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলে আছে!
তনিমার ও ভালো লাগছে!
এবারের মানুষটা চিনতে তনিমার ভুল হচ্ছে না!
হালকা লাগছে তনিমার!
একটু আগের সব কষ্ট ভুলে যাচ্ছে সে!
মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখে কখনোই মানুষকে বিচার করা যায় না!
সেটা সাইজানের বেলায় ঘটলো!
সাইজানের বাহ্যিক রূপ দেখেই তনিমার ভেতর গলে গিয়েছিলো সে বুঝি যেমনটা পেয়েছে তেমনটাই পেয়েছে!
কিন্তু আল্লাহ তো লেবাসধারী সাইজানের রূপটা প্রকাশ করে দিয়ে তনিমাকে এতো বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন!
আল্লাহই তো রক্ষাকারী,,তিনিই উত্তম পরিকল্পনাকারী”
তনিমার ছোট্ট বয়সে সে অনেকবড় শিক্ষা পেয়ে গেছে!
সা’দের ঘরটা খুব সুন্দর করে আজ সাজানো হয়েছে!
বেলি আর গোলাপ ফুলের মাঝখানে কাছুমাছু হয়ে বসে আছে তনিমা!
এশার নামায শেষে তনিমাকে মাহতাবের বউ মুনমুন আবার ও সাজিয়ে দিয়েছে সুন্দর করে!
তনিমার লজ্জা লাগছে ভীষণ,,,এতোক্ষণ ঝটপট থাকলেও এখন প্রচুর লজ্জা এসে তনিমাকে ঘিরে রেখেছে!
সা’দ হাতে খাবার নিয়ে এসে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বসলো!
তনিমা তখন বিছানায় বসে আছে!
সা’দের দিকে তাকাতেও পারছে না তনিমা!
সা’দকে নিয়ে সে এতোটাও কখনো ভাবে নি!
সা’দ প্লেট রেখে বিছানায় বসা তনিমার দিকে তাকালো!
ছোট্ট পিচ্চি তনিমাকে দেখে সা’দের মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে এলো “আমার শ্যামপরী”
সা’দের কথাটা শুনে তনিমার বুক ধ্বক করে উঠলো!
আস্তে করে তনিমার হাত ধরে তনিমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে পাটিতে বসালো সা’দ!
সা’দের স্পর্শে তনিমার রন্ধ্রে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে!
প্লেটে ভাত মাখিয়ে তনিমার মুখে তুলে দিচ্ছে সাথে সা’দ ও খাচ্ছে তৃপ্তি নিয়ে!
তনিমার অস্বস্তি হচ্ছে আবার ভালো ও লাগছে!
তনিমার অবস্থা বুঝে তনিমাকে সহজ করার জন্য বললো সা’দ…
—জানো তনিমা এক প্লেটে এভাবে স্বামী স্ত্রী একসাথে খেলে দুজনের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়!
তনিমা জানে এটা জানতো না এমন ভাবে মাথা নাড়ালো!
সা’দ দুষ্টুমি করে বললো,,,
—জানো না! এখন জেনে যাবে!
সা’দের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে তনিমা যেন মিইয়ে গেলো!
—এই মেয়ে এভাবে দৌড়ঝাপ দিচ্ছো কেন?
যদি কোন অঘটন ঘটে যায়!
সা’দের চিন্তিত মুখ দেখে তনিমা নাক টিপে দিলো সা’দের!
সা’দ নাক উচু করে বললো,,
—তুমি আমাকে কি বাচ্চা পেয়েছো এইভাবে সবসময় নাক টিপে দাও কেন?
আমার নিজেকে বাবু বাবু মনে হয়!
তনিমা সা’দের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে!
পাশের ঘর থেকে তনিমার বাবা-মা তনিমার হাসি শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন!
তনিমার জন্য এতোদিন যে চিন্তা ছিলো এটাও যেন এখন নেই তাদের!
তনিমা চারমাসের প্রেগন্যান্ট এখন!
সা’দ তনিমাকে এখন জার্নি করাতে না চাইলেও তনিমার জিদের সাথে পেরে উঠে নি!
হঠাৎ করে জেদ ধরে বসলো তনিমা বাবার বাড়ি আসবে আর সেই সুবাদেই আজ আসতে হলো তাদের!
তনিমা এসেই বাচ্চাদের মতো এঘর থেকে আরেকঘরে যাচ্ছে!
বড় বোন নুসাইবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে!
নাহুরাই ঘরে এখন!
তনিমা মেঝ বোনের ঘরে উকি দিলো!
নাহুরা তখন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত,,কিন্তু আড়চোখে তনিমাকে উকি দিতে দেখে নিলো ঠিকই!
মোবাইলে চোখ রেখেই বললো নাহুরা,,,
—এভাবে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি না করে ভেতরে আয়!
তনিমা এক গাল হেসে বোনের কাছে গেলো!
নাহুরার চোখ গেলো তনিমার পেটের দিকে!
—বাহ রে! তোর পেটটা তো একটু একটু করে ফুলে যাচ্ছে রে তনি!
মোটা ও হয়েছিস দেখছি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে!
তনিমা প্রতিউত্তরে হাসলো শুধু!
নাহুরার আবার মোবাইলের দিকে মনোযোগ দিলো,,
তনিমা উঁকি দিলো বোনের মোবাইলে……
—আপু তোমার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে শুনলাম!
—হু ঠিক শুনেছিস!
—তুমি কি রাজি?
—না রে! আমি তো অন্য একজনকে ভালোবাসি!
কিন্তু সে এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে নি!
—আপু এক তো বিবাহপূর্ব প্রেম হারাম!
আর হারামে যেহেতু জড়িয়ে গেছো সেটা থেকে তো বের হতেই হবে!
এখন ভাইয়া যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে বলো বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিতে!
—না রে সে পারবে না এখন!
—তাহলে কি করবে আপু?
—জানি না রে! বুঝতে পারছি না!
—আপু বিয়ে যখন করতে পারবে না তাহলে যোগাযোগ রেখে কি লাভ!
—হুম আমি তাই ভাবি!
কিন্তু পারি না!
যোগাযোগ বন্ধ রাখতে অনেকবার চেয়েছি তারপর আবার একদিন পর যেইসেই!
—আপু এটা তো নিছক শয়তানের ধোঁকা!
তুমি নামায পড়ো তাহাজ্জত পড়ো আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও!
আর ভাইয়ার নাম্বার ডিলিট দিয়ে দাও মনকে যথাসম্ভব শক্ত করো পারবে আপু!
আর বিবাহপূর্ব প্রেম হারাম আর এই হারামে কোন সুখ নেই আপু!
রবকে আর অসন্তুষ্ট না করি!
—আমি জানি রে তনি সব জানি!
আমি চেষ্টা করছি দোয়া করিস!
তনিমা বোনের কাছ থেকে উঠে সা’দের কাছে চলে আসলো!
সা’দ মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলো!
তনিমার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে বিছানায় বসলো!
—আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিলো!
সা’দ টেনে তনিমাকে নিজের কাছে এনে বসিয়ে বললো,,,
—কি বলবে বললে ফেলো!
অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন !
—আপনার কি কোন দ্বীনি পরিচিত কেউ আছে যে বিয়ে করতে চায়!
নাহুরা আপুর জন্য একজন সুপাত্র যদি পাওয়া যেত!
সা’দ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,,,
—আছে তো আমার একট ফ্রেন্ড আছে!
অনেক ভালো, উত্তম চরিত্রের অধিকারী!
আমি কি কথা বলবো?
—জ্বী অবশ্যই বলুন!
গুনাহ থেকে বাঁচতে হলে বিয়ের মতো উত্তম কাজটাই করতে হবে!
—বুঝতে পেরেছি তোমার কথা!
আসলে নাহুরা উপযুক্ত হয়েছে ওর বিয়ে এখন জরুরী!
নাহলে সহজেই হারামে জড়িয়ে যেতে পারে!
সবাই তো তনিমা হয় না!
—উহু বেশি বলবেন না তো!
সা’দ মুচকি হেসে তনিমাকে জড়িয়ে বলে,,,
—আমার পিচ্চি “শ্যামপরীটা”
তনিমা লজ্জালু হাসি হাসে!
সা’দের মতো এতো ভালো একটা মানুষ পাবে তার উপর সুদর্শন লোকটা তনিমার মতো কালো একটা মেয়েকে এভাবে আপন করে নিবে তনিমা সেটা কল্পনাও করে নি!
আশার থেকে বেশি আল্লাহ দিয়েছেন তাকে!
শত দুঃখ কষ্টের পর শ্যামপরীটা পেয়েছে সুখের দেখা!
“আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেন”
[আল-কোরআন]
রবের দরবারে শোকরিয়া জানায় তনিমা!
★★★ সমাপ্ত ★★★