
আপু একটু জায়গা হবে ?
মাথা উঁচু করে জান্নাত উত্তর দিল- সিট বুকিং ।
‘ আসলে সিট পাচ্ছি না , এতদূর সিট ছাড়া যাবাে কীভাবে সেটা ভেবেই বললাম । ‘
“ কেন আপনি টিকিট কাটেননি ? ‘
“ না আপু ।
মেয়েটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালােভাবে দেখলাে জান্নাত । হালকা আকাশি রঙের ড্রেস পরা । চুলগুলাে ব্যান্ড দিয়ে আটকানাে । গায়ের রঙ গভীর কালাে । তবে চেহারায় অদ্ভুত একটা আকর্ষণ আছে । দেখে মনে হচ্ছে কোনাে অভিজাত পরিবারের সন্তান । চোখেমুখে চিন্তার ছাপ । কিন্তু মেয়েটা টিকিট না কেটেই ট্রেনে উঠে পড়লাে । রহস্য কী ওর !
মেয়েটা আবার বলল , ‘ আপু , একটু বসতে পারি ?
জান্নাতের কেমন যেন মায়া হলাে , আবার ভয়ও পাচ্ছে । আল্লাহ ভাল । জানেন এই মেয়ের মনে কী আছে । ভয়েভয়ে বলল , বসুন । ট্রেন আপন গতিতে ছুটছে , মেয়েটা জানালার ফাঁকগেলে নির্বাক তাকিয়ে আকাশ দেখছে , কখনও উদাসদৃষ্টে মাঠের সবুজে হারিয়ে যাচ্ছে । কপালে চিন্তার ভাঁজ । আনমনে ভাবছে- কোথায় যাচ্ছি আমি ? কতশত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ।
হঠাৎ জান্নাতের হাতের স্পর্শ পেয়ে ঈষৎ কেঁপে ওঠে । জান্নাত প্রশ্ন করল , “ কোথায় যাবেন আপনি ? ‘ মেয়েটার সরল উত্তর , ‘ জানি । অবাক হয়ে জান্নাত জিজ্ঞেস করল , “ ওমা ! এটা আবার কেমন কথা ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটি বলল , এই জগতটা বড় অদ্ভুত , আরও বড় অদ্ভুত এই জগতের মানুষরূপী পশুগুলাে ।
পৃথিবীতে মেয়েদের কোন মূল্য নেই , মেয়ে মানেই ভােগ্যপণ্য । বলতে পারেন টিস্যু পেপারের মতাে । ব্যবহার করার পরে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেও । জান্নাত হতভম্ভ হয়ে জিজ্ঞেস করল , “ কী হয়েছে আপনার ? একটু খুলে বলবেন ?
মেয়েটা চোখের কোণে অশ্রু মুছতে মুছতে বলল , ‘ আর বাঁচতে মনে চায় ।
এই জগত সংসার মাকাল ফলের মতােই তেঁতাে । উপর দিয়ে আকর্ষণ ভেতরে কালাে । ঠিক এমনই মানুষরূপী হায়েনাগুলাে । আমি রাইতা । ভালােবেসে বিয়ে হয়েছিল সুমন নামের একটি ছেলের সাথে । প্রথম প্রথম । আমাদের সংসার খুব ভালাে চলছিল । শ্বশুর – শাশুড়ি নিয়ে খুব ভালােই দিন কাটাচ্ছিলাম ।
….. হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে আমার জীবনের সব লন্ডভণ্ড করে দিল । জান্নাত উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল , ‘ তারপর ? তারপর কী হয়েছে একটু খুলে বলবেন ? ‘ রাইতা বলা শুরু করল- ‘ সুমনের বােনের বাসা নাটোর , ও প্রায়ই বােনের বাসায় বেড়াতে যায় । একসপ্তাহের নিচে কখনও বাড়ি ফেরে না
ওদের ভাইবােনের মাঝে অনেক মিল , খুনসুটি লেগেই থাকে সবসময় । আমি ভাবতাম ভাইবােনের ভালবাসা অনেক গভীরের কারণে ও বাড়ি আসতে চায় না । কখনও ভিন্নকিছু মনে আসেনি ।
বাড়িতে আমি , শাশুড়ি আর শ্বশুর থাকি । সুমন বাড়ি খুব কম থাকে । শাশুড়িটা জল্লাদের মতাে । আমার চলনে , বলনে সবকিছুতেই সে দোষ খোঁজে । কিন্তু এগুলাে আমার কিছু মনে হতাে না । ভাবতাম সুমন তাে । আছে , ও তাে আমায় ভালােবাসে । ওর ভালােবাসার কাছে অন্যসব তুচ্ছ মনে । হতাে । একবার শাশুড়ি খালাশাশুড়ির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল ।
বাড়িতে আমি একা , শ্বশুর অফিস থেকে বিকেলে আসে । সব কাজ গুছিয়ে দরজা ভিড়িয়ে রুমের লাইট বন্ধকরে শুয়ে ছিলাম । শ্বশুর কখন বাড়ি ফিরেছে বুঝতে পারিনি । তিনি কোনাে আওয়াজ না দিয়েই আমার রুমে ঢুকে পড়েছে । আমি শােয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বললাম- কে ! কে এখানে ! শ্বশুর শান্ত গলায় বলল- আরে আমি , আমি তােমার শ্বশুর ।
তিনি আস্তে আস্তে আমার পাশে এসে বসলাে , মাথায় হাত বুলিয়ে বলল , ভয় পেয়েছাে ? আমি মুচকি হেসে বললাম- না আব্বা , ভয় পাইনি । হঠাৎ লক্ষ করলাম তিনি আস্তে আস্তে আমার পিঠে হাত দিচ্ছে , আচমকা হ্যাঁচকা টানে আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নিল । আমি জোরকরে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম ।
জিনিসটা আমার একদমই ভাল লাগেনি । মধ্যেবয়সী এই মানুষটাকে আমার কাছে জানােয়ার মনে হলাে ।
মদের ভ্যাঁপসা গন্ধে বমি আসার উপক্রম ।
ছিঃ এই মানুষটা মদ খায় ! আমি দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম । শাশুড়ি বাড়ি নেই , বাড়িতে আমি আর শ্বশুর একা । পাশের বাড়ির এক ভাবির সাথে রাতটা কোনরকম পার করলাম । সকালে সুমনকে ফোন করে বললাম , তুমি বাড়ি এসাে , আমার একাএকা খুব ভয় করে । মা বাড়ি নেই । সুমন বলল , আমি অনেক ব্যস্ত , এখন বাড়ি যেতে পারবাে না । মা বিকেলেই বাড়ি ফিরবে ।
সুমনকে বললাম , দেখাে সুমন , বাবার আচরণ আমার মােটেও ভাল লাগছে না । কাল রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে । সুমন খিলখিল করে হেসে বলল , আরে একটু আধটু মদ খেলে কী হয় ! এই বয়সটাই তাে ফুর্তি করার । আমার বাবার বয়স আর কত হয়েছে , এই ধরাে পঞ্চাশ হবে । সুমন ! তুমি কী বলছাে এসব ! তােমার মাথা ঠিক আছে ?! হাসতে হাসতে সুমন ফোন কেটে দিল । শাশুড়িকেও বিষয়টা জানালাম ।
শাশুড়ি রেগে কটকট করতে করতে বলল- সুমনের বাবা তাে তােমারও বাবা । একটু গায়ে হাত দিয়েছে তাতে কী এমন ক্ষতি ? তােমরা বাপু আদরও বােঝে একটু পর তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আরও বলল , এই মেয়ে ! তােমার লজ্জা করে না আমার স্বামীর নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে !
তােমার চেহারার যা সুরত , তােমার ওই কুতসিত চেহারায় আমার স্বামী পাগল হবে তাই ভেবেছাে ? আহ ! কোন পরিবারে আসলাম আমি , কোন অপরাধের শাস্তি হচ্ছে আমার ! এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার চেহারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি , আজ কালাে হয়ে জন্মেছি বলেই কী আমার এতাে শাস্তি ! কালাে মানুষের এই পৃথিবীতে কোনাে দাম নেই ।
সমাজ আমাদের এততা তুচ্ছ মনে করে । বিধাতা কেন আমাকে কালাে বানিয়ে পাঠালাে !
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোনাে উত্তর মেলেনি আমার । বুকের ভেতর এক পাহাড় কষ্ট নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম । সুমন কয়েক মাস ধরে যােগাযােগ করে না । বাবা মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেয় , কিন্তু আমার কোনাে খোঁজ করে না ।
কেমন আছি , কী খেয়েছি , কিছু জানতে চায় না । দিনে পঞ্চাশবারের মতাে কল দিই , রিং হয় কিন্তু সে রিসিভ করে না । রুমের দরজা আটকে কাঁদি , খুব কাঁদি , কিন্তু শব্দ হয় না । আমার যে শব্দ করে কাঁদতে মানা ! আর কাঁদলেও দেখার ও বুঝার কে আছে আমার ! কথাগুলাে একশ্বাসে বলল রাইতা । ততক্ষণে জান্নাতের চোখের কোণে অশ্রু জমে গেছে । জান্নাত বলল , শ্বশুর বাবার মতাে , কিন্তু তার সামনে শালিনতা বজায় রেখে চলতে হবে ।
মুখমন্ডল , দু’হাতের পাতা এবং দু’পায়ের তালু ব্যতীত সবকিছু সতর । স্বামী ব্যতিত অন্যান্য মাহরামের সামনেও এর বেশি খােলা রাখা যাবে । । আর গায়রে মাহরামের সামনে তাে এটুকুও না । কিন্তু আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষ এটা বুঝে না । ‘ জান্নাতের স্বামী মাহমুদ নাস্তা নিয়ে এসে বলল , “ নাও নাস্তা করে নাও । জান্নাত মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলল , ‘ আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে ।
জান্নাতের চোখে পানি দেখে মাহমুদ প্রশ্ন করলাে , “ এই , কাঁদছাে কেন ? ‘ ‘ কই না তাে ! মাহমুদ কথা না বাড়িয়ে সােজা তার সিটে গিয়ে বসে পড়লাে ।
জান্নাত বলল , তারপর কী হলাে ? রাইতা আবার বলা শুরু করলাে । এভাবে পাঁচটি মাস কেটে গেলাে কিন্তু সুমনের কোনাে খোঁজ নেই । পাঁচ মাসের মাথায় সুমন বাড়িতে আসলাে । বলে । বুঝাতে পারবাে না সেদিন আমি কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম । নতুনকরে জীবন
২য় পর্ব
সাজানাের স্বপ্ন বুনেছিলাম আবার । কিন্তু সবার কী আর স্বপ্ন পূরণ হয় ! সবাই কি স্বপ্নের রঙীন ডানায় উড়তে পারে ! উহু ! পারে না । ফোনের রিংটোনের আওয়াজ শুনে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম ‘ সারা ’ নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠলাে । আগপিছ কী যেন ভেবে ফোনটা রিসিভ করলাম । অপর পাশ থেকে অভিমানী সুরে ভেসে আসলাে-
সুমন , এই বুঝি তােমার ভালবাসা ! ফোন ফেলে কোথায় থাকো তুমি ? ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখাে তাে ।
কতবার কল দিয়েছি ! বুঝেছি তুমি আমাকে ভালােবাসাে না , ভালােবাসলে ফোনটা রিসিভ করতে এতাে দেরি হতাে না । আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম , কোনাে উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।
হাত – পা অসাড় হয়ে আসছিল । তবুও একটু সাহস নিয়ে বলললাম- কে আপনি ? আর । কাকে ভালােবাসেন ?
মেয়েটা বলল- আমি সারা ।
সুমনের স্ত্রী ।
আপনি কে ? ‘
আপনি সুমনের স্ত্রী মানে ?
কী বলছেন মাথা ঠিক আছে আপনার ? ‘
আমার মাথা ঠিক থাকবে না কেন ? বললাম তাে আমি সুমনের স্ত্রী ।
ও আচ্ছা ।
তাে আপনাদের বিয়ে হয়েছে কবে ? ‘ ‘
এইতাে দু’মাস আগে ।
আচ্ছা ,
আপনাকে তাে চিনলাম না , সুমনের ফোন । আপনার কাছে কেন ? সুমন কোথায় ? আপনি সুমনের কী হন ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- আমি কেউ নই ।
একথা বলেই ফোন কেটে বারান্দায় চলে গেলাম । নির্বাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি । আমার চোখে এখন পানি নেই । অতি শােকে পাথর হয়ে গেছি । বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু কোনাে শব্দ নেই । অনেক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুমন বলল ,
“ কী ব্যাপার এভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কী করছাে ? ”
কোনাে উত্তর দিলাম না , শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে । এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুমন আবার প্রশ্ন করলাে , এভাবে কি দেখাে ? ক্ষুধা পেয়েছে কিছু খেতে দাও । ” আর চুপ থাকতে পারলাম না । বলেই ফেললাম , ‘ আমার কাছে ক্ষুধার কথা বলে সারার কাছে চাও ।
আমার কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল , ‘ সারা ? সারা আবার কে ? ও … সারাকে চিনাে না । তা ? আরে বলবা তাে সারা কে ? “ কেন তােমার দ্বিতীয় স্ত্রী ! ‘ কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সুমন । কোনাে কথা না বলে ফোনে ব্যাস্ত হয়ে গেল ।
একি ! তুমি আমার ফোন ধরেছিলে কেন ? ‘ কেন আমি বুঝি তােমার ফোন ধরতে পারবাে না ! ‘ ‘ কেন ধরলে সেটা জিজ্ঞেস করেছি ।
‘ ‘ সারা বারবার ফোন দিচ্ছিলাে তাই ধরেছি । ‘
‘ আমার ফোন ধরার সাহস কে দিল তােমাকে ? ‘ ঝাঁজালাে স্বরে বলল সুমন । ‘
তুমি এমন হয়ে গেলে কেন সুমন ? তােমার সেই আগের ভালােবাসা কোথায় গেল ! আগের সুমন আর এখনকার সুমন অনেক পার্থক্য । তুমি তাে এমন ছিলে না ! ভালােবেসেই তাে আমাকে এনেছিলে কিন্তু এখন আমি এতােটাই খারাপ হয়ে গেলাম ? সুমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল ,
তুমি আমার ফোন ধরেছাে কেন ? সারার সাথে কথা বলার সাহস কে দিলাে তােমাকে ? ‘ আমি কাঁদোকাঁদো স্বরে বললাম , তুমি এমন কাজ করতে পারলে । সুমনাবিবেক একটুও বাধা দিল না ? ‘
সুমন আমার গালে ঠাস – করে চড় বসিয়ে বলল , ‘ লজ্জা করে না আমার ফোনে হাত দিতে ! কী আছে তাের ! না আছে চেহারা , না আছে রং , না আছে । তাের বাবার টাকাপয়সা । আয়নায় একবার ভালােকরে দেখ তাে তাের চেহারা ! পাতিলের তলার চেয়েও কালাে তুই । আর এক জিনিস কয়দিন খাবাে । সারার পায়ের সমতূল্যও নস তুই ।
এসব শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি । আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল । গগনবিদারী চিৎকার করে কান্না করেছিলাম সেদিন । তবুও তার অন্তরে একটুও রেখাপাত করেনি । একটিবারের জন্যও আমার কাছে । আসেনি । আমার সামনেই সারার সাথে ফোনে খুঁনসুটিতে মেতেছিল । আমি সহ্য করতে পারিনি ওর এমন আচরণ । রুম থেকে বেরিয়ে অন্যরুমে গিয়ে ঠাস – করে । দরজা আটকে দিলাম ।
এই পৃথিবীর আলাে – বাতাস আর সহ্য হচ্ছিলাে না । নিজেকে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলাম । ওড়নাটা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আমি গলায় প্যাঁচ দেব এমন সময় জোরে জোরে দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিয়েছিল । বারবার সুমন বলছিল , রাইতা দরজা খােলাে ।
আমি কোনাে সাড়াশব্দ না করে চুপকরে ছিলাম । এই পৃথিবীর প্রতি আমার কোনাে মায়া ছিল না । কার জন্য বাঁচবাে আমি ! আজ কালাে বলে সমাজের কাছে । এতােটাই তুচ্ছ আমি । আমার কী দোষ ! বিধাতাই আমাকে সৃষ্টি করেছেন । তাই ঠিক করেছিলাম পরপারে চলে যাবাে ।
কারাে পথের কাঁটা হয়ে থাকবাে না । একটু পর কেন যেন হঠাৎ নিজের জীবনের প্রতি মায়া হলাে । দরজা খুলে বেরিয়ে আসলাম । সুমন বলল , এরকম পাগলামি করছাে কেন , তােমার জন্য আজ আমার জেল হয়ে যেতাে । সুমনের কথাটি যেন আমার কলিজায় সুঁচের মতাে বিধেলাে ।
সহ্য করতে না পেরে বললাম- সুমন , আমার থেকে তােমার জেলখানাটা বড় হয়ে গেল ! জেলখানায় থাকার ভয়ে এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছিলে ? বাহ সুমন , তুমি পারােও বটে ।
সুমন কোনাে কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল । কিছুক্ষণ পর এসে ডিভাের্স পেপার দিয়ে বলল , আমাকে মুক্তি দাও , তুমিও মুক্তি নাও । তােমাকে আমি এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করতে পারছি না । তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাও প্লিজ ! আমি নির্বাক হয়ে শুধু সুমনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম , কোনাে কথা বলার শক্তি আমার ছিলাে না । কোনাে কথা না বলে রুমে চলে গেলাম ।
চিল্কার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলাে কিন্তু কাঁদতে পারিনি । সেদিন আমার চোখে কোনাে পানি ছিল না । একখন্ড পাথরের মূর্তির মতাে চুপকরে বসে ছিলাম । আমার জীবনে এতাে বড় ধাক্কা আসবে বুঝতে পারিনি । অনেক কষ্টে নিজেকে শামলে নিলাম । ব্যাগপত্র গুছিয়ে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়েছি । তবে কোথায় । যাচ্ছি জানি না । শুধু এটুকু জানি , কোথাও যাচ্ছি । জান্নাতের চোখ বেয়ে দরদর করে পানি ঝরছে ।
একমুহূর্তে কোনাে কথা বলার শক্তি তারও নেই । সান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । জান্নাত চোখের পানি মুছে বলল , আচ্ছা আপনার মা – বাবার কাছে গেলে তাে হতাে । এভাবে একাএকা বের হওয়া ঠিক হয়নি ।
‘ বের হওয়া ঠিক হয়েছে কিনা জানি না , তবে মা – বাবার কাছে যাওয়ার ইচ্ছা নেই এখন । তারা আমার এই বিয়ে কিছুতেই মেনে নিচ্ছিলাে না , অনেক জোরকরে মানিয়েছি । আমার এই খবর পেলে জানি না তাদের অবস্থা কেমন হবে ।
তাই আর তাদের কাছে গেলাম না । মাহমুদ এসে বলল , ‘ জান্নাত ওঠো , আমাদের নামতে হবে । জান্নাত মাহমুদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । নরম গলায় মাহমুদ বলল , এভাবে তাকিয়ে কেন ? জান্নাত চোখ নামিয়ে বলল , “ কই না তাে ! জান্নাত রাইতার হাত ধরে বলল , “ আপু আমার নামতে হবে । আপনার জীবন – কাহিনী পুরােটা শােনা হলাে না । আপনি এখন কোথায় যাবেন ?
রাইতার সরল উত্তর- জানি না ।
জান্নাতের খুব ইচ্ছে করছিল ওর সাথে নিয়ে যাওয়ার , কিন্তু একজন অজানা – অচেনা মানুষকে নিয়ে ওর যদি কোনাে বিপদ হয় ! গাড়িতেই পরিচয় , এটুকু পরিচয়ে কাউকে বেশি আপন করা ঠিক না ।
এসব আগপিছ ভেবে জান্নাত রাইতার হাত ধরে বলল , ‘ আপু আসি । জান্নাত নেমে গেলাে । রাইতা জান্নাতের হাঁটার দৃশ্য দেখছে আর ভাবছে কালাে বােরকা , ইয়া বড় ওড়না পেঁচিয়ে আবার হাতে – পায়ে মুজা পরে এদের কষ্ট হয় না ! যেখানে একটা ওড়না পেঁচাতেই আমার কষ্ট লাগে , সেখানে কালাে বােরকা !
কীভাবে সম্ভব !
নাহ , মেয়েটার কথা ভাবলে চলবে না । আমার গতিহীন অনন্ত পথের কথাই বরং চিন্তা করি । ঢাকায় গিয়ে কোথায় উঠবাে আমি ! বান্ধবী শায়লাকে ফোন দিয়ে বরং খোঁজ নিই , দেখি ওর কাছে ওঠা যায় কি না । শায়লাকে ফোন দিয়ে বলল ,
“ তাের সাথে আমাকে কিছুদিন রাখবি ? ” ‘ আয় , আমি ম্যানেজ করে নেব । ‘ কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলাে রাইতা । ঝকঝক , ঝকঝক রবে ট্রেন চলছে । নীরব নিস্তব্ধ চারপাশ । ঝােপঝাড় পেরিয়ে মাঝবয়েসী ট্রেনটা চলছে তাে চলছেই । কত কথা , কত স্মৃতি রাইতার মানস্পটে উকি দিচ্ছে !
কত বিচিত্রময় এইজীবন । কোথায় ছিলাম আজ কোথায় যাচ্ছি আমি ! ট্রেন থেমে গেল । লােকজন নামতে শুরু করলাে । রাইতা উঠে দাঁড়ালাে । হঠাত পায়ের সাথে কিসের যেন ছোঁয়া লাগলাে । পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাে একটা ডায়েরি পড়ে আছে । ডায়েরির রং – টা নীল । গাড় নীল । হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে বলল , বাহ ! চমকার ডায়েরি তাে ! মনে হয় বােরকাওয়ালী মেয়েটা ফেলে গেছে ।
ডায়েরিটা নিয়ে নেমে পড়লাে রাইতা । শায়লার বাসায় গিয়ে উঠলাে ।
বান্ধবীকে পেয়ে শায়লাও বেশ আনন্দিত হলাে । একসপ্তাহ শায়লার বাসায় কাটালাে । রাইতা বলল , ‘ শায়লা , আমাকে কোন কাজ খুঁজে দিবি ? আর কোথাও ফিরে যেতে চাই না ।
মায়ের কাছেও না । শুধুশুধু ভাই বউয়ের বােঝা হতে যাবাে কেন ? কোন কাজে লেগে গেলে মনটাও ভালাে থাকবে আমার দিনও চলে যাবে । ‘ শায়লা মনেমনে ভাবলাে , কোনাে কাজে লাগিয়ে আপাতত আপােদ দূর করলেই হয় । কতদিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবাে ? হােক না বান্ধবী , আমারও তাে । সংসার আছে ।
শায়লা বলল , চল , দেখি গার্মেন্টসে কোনাে কাজ পাই কি না । শায়লা , রাইতা কাজের উদ্দেশ্যে বের হলাে । সারা শহর তন্নতন্ন করেও কোনাে কাজের হদিস না পেয়ে বাসায় ফিরে এলাে । ফ্রেস হয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে । শুয়ে পড়লাে রাইতা । রাতের খাবার খেলাে না ।
শুয়ে শুয়ে ভাবছে , এই জগত সংসার এমন কেন ! অন্তরে কোনাে শান্তি । পাচ্ছে না সে । এপাশ – ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুম আসছে না । হঠাত নীল । ডায়েরিটার কথা মনে পড়লাে । লাইট জ্বালিয়ে ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে উল্টাতে লাগলাে ।
উল্টাতে উল্টাতে এসে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল । সেখানে লেখা ছিল “ হতাশ হয়াে না । জীবনে অনেক ঝড় আসবে , তাইবলে নিজেকে শেষ করে দিতে হবে ? জীবন একটিই , এজীবনকে মূল্যায়ন করতে হবে ।
যখন তুমি হতাশার গহিন অরণ্যে হারিয়ে যাবে , ঠিক তখনই নামাজের দাঁড়িয়ে যাবে । কাঁদবে , খুবকরে কাঁদবে । তবে জায়নামাজের বুকে । চোখের পানি অমূল্য । অপাত্রে এর অপচয় কোরাে না । আল্লাহর সামনে সব অভিযােগ পেশ করবে ।
পৃথিবীতে এই একটিই প্রশস্ত জায়গা আছে , সেটা হলাে জায়নাজের বুক । জায়নাজের বুকে কেঁদে কেঁদে মালিকের কাছে সব অভিযােগ পেশ করবে , শান্তি পাবে । মনে তৃপ্তি আসবে । শুভ্রতার আবেসে আবেশিত হবে । কারণ তিনি কাউকে ফিরিয়ে দেন না । কারাে প্রতি জুলুম করেন না । ”
লেখাটা পড়ে রাইতার চোখ ছলছল করে উঠলাে । মনেমনে ভাবতে লাগলাে , এভাবে তাে কখনও ভেবে দেখিনি ! আমি তাে স্রষ্টাকে কখনও স্মরণ করি না । নামাজ পড়ি না । অথচ মুসলিম ঘরে জন্ম আমার । ডায়েরিটা বন্ধ করে অযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল রাইতা । সুরা – কেরাত যেরকমই পারে সেভাবে নামাজ পড়লাে ।
এশার নামাজ পড়ে আরও দু’রাকাআত বেশি পড়লাে । দু’হাত উঠালাে আল্লাহর দরবারে । অজান্তেই টপটপ করে অশ্রু ঝরছে । কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলাে- হে আল্লাহ !
আমি এক অধম বান্দি গুনাহের
বােঝা মাথায় নিয়ে তােমার আলিশান দরবারে দু’টি হাত উঠিয়েছি । তুমি আমাকে তােমার রহমতের চাদরে জড়িয়ে নাও মাওলা !
এভাবে মনের যত চাওয়া সব আল্লাহর দরবারে নিবেদন করলাে সে । মুনাজাত শেষ করতেই রাইতার পুরােটা সত্তা জুড়ে অদ্ভুত মিষ্টি আবহ খেলে যায় । ভিন্নরকম ভাললাগা কাজ করে । কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে রাইতা । সকালে ফজরের সময় উঠে যায় সে ।
নামাজ আদায় করে মােবাইলটা অন করে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে তিলাওয়াত শুনতে থাকে । তিলাওয়াতের মুছনায় মিষ্টি আবহের তরঙ্গে দোল খেতে থাকে সে । চোখে মুখে স্নিগ্ধের আভা । প্রশান্তির জোয়ারে ভাসতে থাকে । অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে -আলহামদুল্লিল্লাহ ! আমি আমার আসল ঠিকানা পেয়ে গেছি । শান্তির জায়গা পেয়ে গেছি ।
আবার ডায়েরিটা হাতে নেয় রাইতা । ডায়েরির উপরে হাত বুলাতে থাকে । বুকের সাথে মিশিয়ে বলতে থাকে- তুই আমার পরম বন্ধু । তাের জন্য আমি আমার স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়েছি । আমার আসল ঠিকানা পেয়েছি ।
ডায়েরিটাকে আদরকরে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাে । আজ ডায়েরিটা পড়ে শেষ করবে সে । প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাে “ সবাই সাদার সৌন্দর্য খোঁজে , কালাের সৌন্দর্য ক’জন বােঝে ! সাদা গােলাপ দেখতে সুন্দর , কিন্তু কালাে গােলাপটা আরও বেশি মনহর !
কখনও কখনও কালাের কাছে সাদা হার মেনে যায় । কালাে ! সে তাে প্রভুরই দান । তুমি
কালাে তাতে মন খারাপ করার কিছু নেই । আল্লাহ তােমাকে ভালােবেসে তাঁর নিপুণ হাতে সৃষ্টি করেছেন । মানুষের চাহিদার কাছে তুমি অসুন্দর হতে পারাে , কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি তাে সেরা ।
যে তােমাকে কালাের কারণে অবজ্ঞা করে , জেনে রেখাে সে কিন্তু স্রষ্টাকেই অবজ্ঞা করলাে ।
আল্লাহর সৃষ্টিকে কটাক্ষ করলাে । তুমি ভেবাে না , মন খারাপ কোরাে না ।
তুমি তােমার সৃষ্টি নও , আল্লাহর সৃষ্টি । সাদা – কালাে , ধনী – গরীব সবই আল্লাহর দান ।
এতে মন খারাপ করার কিছু নেই এবং অহংকার করারও কিছু নেই । আল্লাহ চাইলেই টাকা পয়সা , চেহারার আকর্ষণ সবই কেড়ে নিতে পারেন ।
নিজের যেটুকু আছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকো , শান্তি পাবে । ” রাইতা পড়তে পড়তে ভাবনার গভীরে হারিয়ে গেলাে । আহ !
মেয়েটা কেমন যেন সব আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলছে। সবকিছু আমার জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছে ।
কী অদ্ভুত সমীকরণ । আসলেই তাে সবই আল্লাহর সৃষ্টি , তবুও মানুষ কেন বুঝে না !
নাহ , আর অযথা কেঁদে নিজের জীবন নষ্ট করবাে না । কালাে । তাতে কী , আমি তাে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি । আমার কাঁদলে চলবে না । আমি হাসবাে , মনখুলে হাসবাে । কালাে বলে নিজেকে ছােট ভাববাে না ।
শায়লা এসে বলল , কিরে রাইতা নাশতা করবি না ? কখন থেকে ডাকছি তোকে ।
‘ জানিস শায়লা , আমি আমার আসল গন্তব্য খুঁজে পেয়েছি । ‘
‘ তাই নাকি ? কী সেটা ?
রাইতা ডায়েরির কথাগুলাে খুলে বলল , বােরকাওয়ালী মেয়েটার কথাও বলল । শায়লা বলল , ‘ সব ঠিক আছে কিন্তু বােরকা পরে সুফি সাজা আমার ভালাে লাগে না । এটা বেশি বাড়াবাড়ি । মনের পর্দা বড় পর্দা । আমি যদি খারাপ কিছু না করি তাহলেই তাে হলাে । বােরকা পরে হাত মুজা , পা মুজা পরে চলা ।
এটা আবার কোন আদিখ্যেতা ! এই বােরকাওয়ালীদের মধ্যেই বেশি শয়তানি । খুঁজে দেখ , যারা সমাজে চলে না তারাই এরকম বােরকা পরে সং সাজে ।
রাইতা কোনাে উত্তর খুঁজে পেলাে না । সেও তাে জানে না পর্দার গুরুত্ব কতখানি কথা না বাড়িয়ে ডায়েরি পড়ায় আবার মনযােগ দিল রাইত । আবার । একটি লেখায় চোখ আটকে গেল ।
” আত্মহত্যা ! সে তাে মহাপাপ । যদি হতাশার গহিন অরণ্যে হারিয়ে যাও , যদি জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তবুও আত্মহত্যা কোরাে না । তােমার জীবনের মূল্য অনেক । হে মন , তুমি কি ভেবে দেখেছাে পরকালের পরিনতির কথা ! ভেবেছাে কি কখনও কিয়ামতের কঠিন দিনের কথা । কেন তােমার এতাে উদাসীনতা ! কেন অবৈধ পথে ছুটে চলা ! তােমার হাতে যার জীবন তার হাতেই তােমার মৃত্যু । নিজের হাতে নিজেকে শেষ কোরাে না , ধ্বংস হয়ে যাবে । ”
অদ্ভুত তাে ! মেয়েটা অকপটে আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে । এটা বুঝি নিয়তি ! যেখানে কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায় , সেখান থেকেই হয়তাে আল্লাহর সাহায্য শুরু হয় । আল্লাহ আমাকে হয়তাে পরিক্ষা করেছিলেন । এতােদিন ।
নাশতা সেরে শায়লা আর রাইতা আবার কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাে । রােদের তীব্রতায় প্রাণ উষ্ঠাগত অবস্থা । লােকাল বাসে বাদরের মতাে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছে তারা । গরমের ভ্যাপসা গন্ধ , তারমধ্য বাসের উপচেপড়া ভীড় । অসহ্য এক পরিস্থিতি । নারী – পুরুষ কোনাে ভেদাভেদ নেই ।
ডলাডলি , মাখামাখি তাে আছেই । রাইতা এতােটা ভীড়ের কবলে কখনও পড়েনি । ঢাকা শহরের জ্যাম , লােকাল বাসের পরিস্থিতির সাথে রাইতা পরিচিত না । নারী – পুরুষের এই মিশ্র ভ্যাপসা গন্ধ ওর সহ্য হচ্ছে না ।
রাইতা শায়লাকে ডেকে বলল , ‘ শায়লা , সহ্য হচ্ছে না , নেমে পড় । দেখ , ছেলেগুলাে কীভাবে মেয়েদের সাথে আটকে আছে , আর মেয়েগুলােও বা এতাে বেয়াদব কেন ? চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । আমার সহ্য হচ্ছে না শায়লা ! ‘
শায়লা রাগান্বিত হয়ে বলল , ‘ আরে চুপ কর !
লােকাল বাসে আর কী চাস ! এখন কি আমি তাের জন্য প্রাইভেট কার ভাড়া করে আনবাে ! এভাবেই চলা শিখতে হবে । ছেলেরা পারলে আমরা পারবাে না কেন ? ” রাইতা কথা না বাড়িয়ে চুপ হয়ে গেল । গার্মেন্টসে গিয়ে আজও কোন কাজ পেলাে না ।
হতাশ হয়ে আবার ফিরে এলাে । রাইতা বলল , ‘ আর কাজের সন্ধানে যাবাে না । এই গরমে বাদরের মতাে ঝুলে ঝুলে ছেলেদের ঠেলাঠেলি খেয়ে আর যাইহােক কাজে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না । তারচেয়ে আমি বরং মায়ের কাছে ফিরে যাই ।
ওখানে গিয়ে টিউশনি খুঁজতে থাকবাে । টিউশনি করে আমার পেট চলে যাবে । ‘ শায়লা বলল , ‘ তাের যা ভাল লাগে তাই কর । পরদিন শায়লার বাসা থেকে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলাে । রাইতা । শায়লা হাজার দুয়েক টাকা রাইতার হাতে গুজে বলল ,
“ এই নে ভাড়া , আর কিছু কিনে খেয়ে নিস । ট্রেনের টিকিট কেটে সিটে গিয়ে বসলাে রাইতা । আজ কেউ নেই ওর পাশে , তবে সেই বােরকাওয়ালীর কথা ভাবছে রাইতা , আর ভাবছে নীল ডায়েরির কথা।
ডায়েরির কথা মনে পড়তেই ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে পাতা উল্টাতে লাগলাে । রাইতা মনে মনে বলছে , বাহ ! বােরকাওয়ালীর হাতের লেখা বেশ দারুণ তাে ! আবার প্রত্যেকটা লেখা অনেক শিক্ষণীয় । পর্দা সম্পর্কীয় একটা লেখায় রাইতার চোখ আটকে যায় , লেখাটা একটা গল্পকারে ছিল ঠিক এমন …
“ আমরা ক’জন বান্ধবী নদীর কোল ঘেঁষে হাটছি , গােধূলি লগ্নে পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়া সূর্যের লালিমা আর পাখীদের নীড়ে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য দেখছি । কখনও নদীর জল ছুঁয়ে দেখছি , আবার কখনও খুঁনসুটিতে মেতে উঠছি । আমাদের খুঁনসুটি দেখে পাশ থেকে একদল কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা বলাবলি করতে লাগলাে , এই দেখ , দেখ , নদীতে ভুত আসছে ভুত ।
আবার কেউ বলছে আরে ভুত না এরা হলাে জঙ্গী পার্টি । আবার কেউ বলছে , বােরকা পরেছে ঠিকই ।
কিন্তু ওদের ভেতরে গিয়ে খবর নিলে দেখা যাবে সবকয়টা মিনমিনে শয়তান ।
শেষ পর্ব
আমাদের মধ্যে থেকে সানিহা নামের একটা মেয়ে বলে ফেলল- পর্দা আমাদের অলংকার , পর্দাই আমাদের অহংকার । তাদের মধ্য থেকে একজন পিশাচিনীর মতাে হেসে উঠে বলল , হেহ ! আইছে অলংকারওয়ালা ।
ভুত হয়ে সং সেজে আবার অলংকার দাবি করছে । আমরা মেয়েগুলাের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । সানিহা বলল , আচ্ছা , কিছুপ্রশ্ন করি , উত্তর দেবেন ? তাদের মধ্যে একজন বলল- বলেন শুনি কী প্রশ্ন ! সানিহাপ্রশ্ন করলাে , আপনার স্বর্ণ অলংকার কোথায় রাখেন ?
মেয়েটি অকপটে উত্তর দিলাে , কোথায় রাখবাে আবার , আলমারিতে রাখি ! সানিহা আবার বলল , কেন , ওগুলাে বাহিরে রাখতে পারেন না ? মেয়েটি ভেংচি কেটে বলল , আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? এতাে দামি জিনিস কোনাে পাগলেও বাইরে রাখে না । আপনার মাথায় আসলে গােবর ভরা ।
পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলাে , আরে , এদের মাথায় গােবর ভরা থাকবে না তাে কী থাকবে , সারাদিন মাথায় কাপড় দিয়ে সং সেজে থাকলে তাে গােবরই হবে । মাথায় মগজ – টগজ থাকলে এরকম প্রশ্ন করতাে না ।
ওদের কথা শুনে সানিহার খুব অপমানবােধ হলাে , মেয়েগুলাে পর্দা নিয়ে উপহাস করলাে ! অথচ পর্দা একটি ফরজ বিধানসানিহা এদিক
– ওদিক ভালাে করে তাকিয়ে মুখ থেকে নেকাব সরিয়ে বলল , আমাকে দেখতে কি কাইল্লা ভুতনির মতাে লাগে ? মেয়েগুলাে একজন আরেকজনের দিকে চোখাচোখি করে মিনমিনকরে বলতে লাগলাে , আসলেই তাে মেয়েটা অনেক সুন্দর ! তাহলে বােরকা পরে এমন সং সাজে কেন ?
সানিহা বলল , এই যে শুনুন , আমরা ঢং করে সং সেজে বােরকা পরি না ।
আমরা বােরকা পরি কারণ এটা আল্লাহর বিধান । আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে স্পষ্ট বলেছেন- হে নবী পত্নীগন ! তােমরা সাধারণ স্ত্রী লােকের মতাে নও ।
যদি তােমরা তাকওয়া অর্জন করে । থাকো , তাহলে কোমল স্বরে কথা বলবে না । কেননা , এতে যাদের মনে বিকৃতি আছে তারা প্রলুদ্ধ হবে , বরং সংযতভাবে কথা বলবে । ( যেমনটা পুন্যবতী নারীগন বলে থাকেন ) আর তােমরা গৃহেই অবস্থান করবে এবং জাহেলিয়াতের
যুগের ন্যায় বেপর্দা অবস্থায় বের হয়াে না ।
আর তােমরা নামাজ কায়েম করাে , যাকাত আদায় করাে , আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুগত্য করাে । ” ( সুরা আহযাব : এবং হাদিসে বলা হয়েছে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ( রাযি . ) বর্ণনা করেন ,
রাসুল ( সা . ) বলেছেন , নারী হলাে গােপনীয় জিনিস । যখন সে বাইরে বের হয় , শয়তান তার দিকে তাকাতে থাকে ।
আর নিঃসন্দেহে একজন স্ত্রীলােক থাকে ।
-তাবরানী আল্লাহ পাকের সবচেয়ে নিকটবর্তী ওই সময় হয় যখন সে ঘরের অভ্যন্তরে উল্লেখিত হাদিসে প্রথমত নারীজাতির মর্যাদা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে , ‘ নারী সত্তা ’ গােপন রাখার বিষয় এবং পর্দার আড়ালে থাকাই তার জন্য শােভনীয় ।
যে সকল নারীরা পর্দার বাইরে ঘােরাফেরা করে , তারা নারীত্বের অবমাননাকারী । তারপর বলা হয়েছে যখন কোনাে নারী ( বিনা প্রয়ােজনে ) ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার পেছনে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে । দুনিয়ার গরম থেকে জাহান্নামের গরম অনেক বেশি ,
জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে রক্ষা পেতে আমরা বােরকা পরি । পর – পুরুষকে নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে আকৃষ্ট করি না । আপনার স্বর্ণ যেমন দামি প্রতিটা মেয়ের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রতঙ্গ স্বর্ণের চেয়ে কয়েক কোটি গুণ দামি ।
আচ্ছা বলুন তাে , আমার এতাে দামি জিনিস সস্তায় পর – পুরুষের সামনে বিলিন করে দেব কেন ! তাদের লােলুপ দৃষ্টি আমার সৌন্দর্যের দিকে আকৃষ্ট করাবাে কেন ! আমি বাজারের পণ্য নই যে ,
যার যেমন ইচ্ছা সে তেমনভাবে আমাকে নিয়ে তামাশা করবে । আমরা আল্লাহর একটি দান , সেই দানের মূল্যায়ন আমরা করবাে । চাই কেউ কাটার আঘাতে জর্জরিত করুক , বা না করুক । আজ আমি পর্দা করি বলেই আমি স্বাধীন , আজ আমি স্রষ্টার হুকুম মেনে চলার চেষ্টা করি বলেই আমি স্বাধীনভাবে চলতে পারি ।
পর্দা মানেই পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হওয়া নয় । আমি পর্দা করি বলেই টিশার্টে ‘ সরে দাঁড়ান ‘ স্লোগান লিখতে হয় না , বরং ছেলেরা আমায় সম্মান দেখিয়ে নিজেদের আসন ছেড়ে আমাকে বসতে দেয় ।
আজ আমি পর্দা করি বলেই রাজপথে নেমে বেহায়া বেশে নারী অধীকারের স্লোগান দিতে হয় না , বরং আমার অধিকার , আমার সম্মান আমি পর্দার মাঝেই খুঁজে পেয়েছি । সানিহার এই তেজোদ্দীপ্ত কথাগুলাে শুনে মেয়েগুলাে বােকা বনে গেলাে ।
কোনাে উত্তর খুঁজে পেলাে না তারা । খুঁজে পাওয়ার কথাও না । মেয়েগুলাে কোনাে কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চলে গেলাে । সেই দিনটি আমাদের স্মরণীয় একটি দিন । আজও সেই নদী আছে , আকাশ আছে , সন্ধ্যার লালিমা আছে , কিন্তু
আমাদের সেই সােনালী দিনগুলাে নেই । সবাই নিজনিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । জীবনের কী বৈচিত্রময় সমীকরণ !
” রাইতা ডায়েরি বন্ধ করে ভাবতে থাকে , সত্যিই তাে পর্দার মাঝে স্বাধীনতা আছে ।
আমি কত ভুলের মধ্যে আছি ! কতকিছু জানার বাকি । সারাজীবন শুধু পার্থিব সুখ খুঁজেছি কিন্তু পাইনি ,
আসল সুখের ঠিকানা কখনও খুঁজে দেখিনি , দেখার চেষ্টাও করিনি । রাইতা মনেমনে ঠিক করলাে সে পরিপূর্ণ পর্দা করবে । রাইতা বাড়ি গিয়ে মাকে সব খুলে বলার পর ওর মা অসার হয়ে পড়লাে । মেয়ের এমন পরিণতি আগেই তিনি ধারণা করেছিল । নিষেধ করেছিল মেয়েকে ।
শােনেনি । রাইতার মা ভারাক্রান্ত মনে বসে আছে । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর মাকে গিয়ে বলল ,
“ মা ! আমাকে হাজার দুইয়েক টাকা দিতে পারবে ? খুব দরকার । রাইতার মা মেয়েকে দুইহাজার টাকা দিয়ে বলল , “ বাজে কাজে খরচ করিস না মা !
রাইতা বলল , ‘ মা ! আমি আর আগের রাইতা নেই । আমি অনেক পরিবর্তন হয়েছি । আমি পরিপূর্ণ ইসলাম মেনে চলতে চাই । আমি অন্ধত্বের বেড়াজালে আর আবদ্ধ থাকতে চাই না ।
আমি একটা সুন্দর জীবন চাই । এই পার্থিব জীবনের মােহ এখন আর আমাকে মােহিত করে না । আমি সুখের সন্ধান পেয়েছি । আসল ঠিকানা পেয়েছি । রাইতা তার মাকে ট্রেনের বােরকাওয়ালী মেয়েটার ডায়েরির কথা বলল ।
এই ডায়েরি থেকে পাওয়া আলাের মশালের কথা শুনালাে । রাইতার মা খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে মেয়েকে ধরে কান্না করতে লাগলেন । রাইতাও কাঁদতে থাকলাে
কাঁদুক রাইতা এবং তার মা । এই কান্নায় বাধা দিতে নেই ।
কিছুক্ষণ পর রাইতা নিজেকে শামলিয়ে বলল ,
“ মা জানাে , এই দুইহাজার টাকা দিয়ে আমি একটা বােরকা কিনবাে । আমি পরিপূর্ণ পর্দা করবাে মা ।
ট্রেনের বােরকাওয়ালীর নাম্বার পেয়েছি ডায়েরির শেষ পাতায় । তার সাথে কথা বলবাে , তাকে আমাদের বাসায় দাওয়াত দিলে কেমন হয় মা ?
পরিবর্তন তাকে আমি একনজর হলেও দেখতে চাই ।
‘ রাইতার মা বলল , “ খুব ভাল হবে । যার জন্য আমার মেয়ের এতাে রাইতা জান্নাতকে ফোন দেয় কিন্তু রিসিভ হয় না । দশ থেকে বারাে বার ফোন দেওয়ার পরে জান্নাত ফোন রিসিভ করে ।
রাইতা বলল ,
“ আপু , আমি রাইতা , চিনতে পেরেছেন ?
‘ ঠিক চিনতে পারলাম না ।
‘ ওই যে ট্রেনে দেখা হয়েছিলাে !
“ ও আচ্ছা আচ্ছা !
সেই রাইতা ! মনে পড়েছে !
তাে আমার নাম্বার পেলেন কোথায় ?
‘ আপনার ডায়েরিতে । আপনি একটা নীল ডায়েরি ফেলে গিয়েছিলেন দেখছাে !
অনেক খুঁজেছি ডায়েরিটা । কোথাও পাইনি । অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর প্রতিটা পাতায় । রাইতা বলল ,
“ যেই ডায়েরি জুড়ে আপনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে , সেই ডায়েরি জুড়ে আমার নতুন একটি জীবন জড়িয়ে ছিল । জান্নাত বিস্ময় হয়ে বলল ,
“ নতুন জীবন মানে ? ‘
আপনার ডায়েরি থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছি আমি । অনেক ভুল থেকে বেরিয়ে এসেছি । জানেন আপু , আমি এখন বােরকা পরি , পরিপূর্ণ ইসলাম মেনে চলার চেষ্টা করি । আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি । নিজেকে শুধরে নিয়েছি । এখন আমার জীবনে আর কোনাে চাওয়া – পাওয়া নেই ।
এখন শুধু রবের তরে একটিই চাওয়া , তিনি যেন আমাকে পরকালে ক্ষমা করে দেন । আপু , আপনার ডায়েরিটা ফেরত দিতে চাই , এই ডায়েরি জুড়ে আপনার অনেক স্মৃতি আছে । আমার আম্মু আপনাকে দাওয়াত দিয়েছে । ভাইয়াকে নিয়ে আসবেন অবশ্যই ।
জান্নাত বলল , “ সত্যিই আজ নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে । আমার মতাে সাধারণ একজন মানুষের ডায়েরি থেকেও কেউ দীনের পথ পায় ! সত্যিই অভিভূত আমি । যেই ডায়েরির মাধ্যমে আপনি হেদায়েত পেয়েছেন সেই ডায়েরি আমার স্মৃতির থেকে আপনার কাছে থাকলে আমি বেশি খুশি হবাে ।
এতেই আমি আমার সুখ খুঁজে পাবাে । যদি একটি ভালাে । কাজের জন্য পরকালে মাফ পেয়ে যাই তাহলে আমারও এই জীবনে আর কোনাে চাওয়া – পাওয়া নেই ।
দ্বীন- মানুষের জীবনের অযাচিত চাওয়া – পাওয়ার উচ্চাভিলাষীতাকে বুঝি এভাবেই বিলীন করে দেয় ? এভাবেই বুঝি জীবনের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন ।
করিয়ে দেয় ? আর এভাবেই বুঝি জীবনের পরতে পরতে বিজয়ী করে দেয় ?
আলহামদুলিল্লাহ ।